বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল পড়ুয়া আদিবাসী যুবক বিমানে দিল্লি গিয়ে যোগ দিলেন একটি ‘অনলাইন কোর্সে’র ‘অফ লাইন মিট’-এ। বছর কুড়ির নির্দেশ মুড়ার গ্রামে এখনও মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তারই মধ্যে ‘এথিক্যাল হ্যাকিং’র কিছু কৌশল রপ্ত করেছেন নির্দেশ। আর সেই সূত্রেই তাঁর রাজধানী যাত্রা।
ছোটবেলা থেকেই মোবাইল টানে আমলাশোলের বাসিন্দা নির্দেশকে। ধীরে ধীরে ঝোঁক বাড়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে। নেটওয়ার্কের বাধা পেরিয়ে নিজে নিজেই শিখে ফেলেন ‘এথিক্যাল হ্যাকিং’-এর কৌশল। তবে প্রথাগত পড়াশোনার ঘাটতি নির্দেশ অনুভব করেন প্রতি মুহূর্তে। নম্বর বেশি না থাকায় একাদশে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি। তাই আপাতত বেলপাহাড়ি এসসি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কলা বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন নির্দেশ। আমলাশোল থেকে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে কাঁকড়াঝোর। সেখান থেকে বাসে ২৪ কিলোমিটার উজিয়ে স্কুলে। এই পুরোটা সময় নির্দেশ মগ্ন থাকেন মোবাইলে। গেমস কিংবা সমাজমাধ্যম নয়। শেখেন তথ্য প্রযুক্তির খুঁটিনাটি। নির্দেশ জানান, নয়াদিল্লির একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ‘এথিক্যাল হ্যাকিং’য়ের ‘সিকিয়োরিটি প্রফেশনাল’-এর ছ’মাসের অনলাইন কোর্স করেছেন তিনি। শনিবার গুড়গাঁওয়ে ছিল কোর্স সমাপ্তির ‘অফলাইন মিট’। সেখানে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নির্দেশও যোগ দেন। নির্দেশের কথায়, ‘‘বিমানে চড়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল। আমি এমন গ্রামের ছেলে যেখানে আগে চলার পথ, পরিস্রুত পানীয় জল স্বপ্ন ছিল। ২০০৪-এ গ্রামে অপুষ্টিজনিত কারণে পাঁচ আদিবাসীর মৃত্যুর পরে এখন আমলাশোল একেবারেই বদলে গিয়েছে। বাড়িতে বসে ওয়াইফাইয়ের দৌলতে বিশ্বকে চিনেছি।’’
নির্দেশের বাবা লক্ষ্মীকান্ত মুড়া চাষাবাদ করেন। বছর তিনেক আগে হাওড়ার দুই বিনিয়োগকারীর উদ্যোগে লক্ষ্মীকান্তের জমিতে আমলাশোলের প্রথম হোম স্টে তৈরি হয়। তার পর লক্ষ্মীকান্তের জমিতে হুগলির কিছু বিনিয়োগকারীর উদ্যোগে আরও একটি হোম স্টে হয়েছে। এখন সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। লক্ষ্মীকান্ত বলেন, ‘‘ছেলের আগ্রহ দেখে ল্যাপটপ, ট্যাব কিনে দিয়েছি।’’ নির্দেশ জানান, শুক্রবার দমদম থেকে দিল্লি গিয়ে দেখেছিলেন ইন্ডিয়া গেট, রাষ্ট্রপতি ভবন সহ কিছু দর্শনীয় জায়গা। শনিবার অফ লাইন মিট সেরে রবিবার ফিরেছেন বাড়ি।
ভবিষ্যতে সাইবার ক্রাইম রোখার জন্য আরও কিছু প্রশিক্ষণ নিতে চান নির্দেশ। লক্ষ্মীকান্ত বলছেন, ‘‘আমি দশম শ্রেণির পর স্কুলছুট। আমার স্ত্রী জয়ন্তী নিরক্ষর। আমরা দূরে বাইরে যেতেই ভয় পাই। সেখানে ছেলে যে ভাবে দিল্লি ঘুরে এল আমি তাজ্জব।’’ আমলাশোলের সুনীল মুড়া, কাঁকড়াঝোরের প্রদীপ মাহাতোদের কথায়, ‘‘এলাকার কেউ আগে বিমানে চড়েনি। নির্দেশই প্রথম বিমানে চড়ল।’’
ঝাড়গ্রামের জেলা শাসক সুনীল আগরওয়াল বলছেন, ‘‘এই ঘটনাই প্রমাণ করছে আমলাশোল-সহ প্রান্তিক এলাকাগুলি কতটা বদলে গিয়েছে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)