কাকদ্বীপের রথতলার বাড়িতে অন্তঃসত্ত্বা অর্চনা দাস। নিজস্ব চিত্র
আশেপাশে কারও ঘরের ছাউনি উড়ে যাচ্ছে, উপড়ে যাচ্ছে গাছ। সঙ্গে বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ। তেলের কুপি জ্বালানো ঘরে স্ত্রীর হাত চেপে ধরে নবীন স্বামী বলেছিলেন, ‘‘ভয় পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
রবিবার অবশ্য তরুণটি বললেন, ‘‘বৌকে সাহস দিলেও নিজে আতঙ্কে ছিলাম। ভাবছিলাম, প্রসবযন্ত্রণা উঠলে, খবর দিলে অ্যাম্বুল্যান্স তো আসবে। কিন্তু ওকে বাইরে বার করব কী ভাবে? বাচ্চার কী হবে?’’ ঝড়ের রাতে অবশ্য আর হাসপাতালে যেতে হয়নি। কিন্তু সারা রাতই কেটেছে আতঙ্কে। যে-আতঙ্কের ছাপ রবিবার দুপুরেও চোখেমুখে লেগে রয়েছে কাকদ্বীপের রথতলার দম্পতি অনিরুদ্ধ ও অর্চনা দাসের। হবু মায়ের কথায়, ‘‘বাতাসের শব্দ যত বাড়ছিল, ভয় হচ্ছিল। তবে ও সাহস দিচ্ছিল তো। আর যন্ত্রণাও হয়নি। হয়তো ভয়েই।’’
১৪ নভেম্বর অর্চনার প্রসবের তারিখ। তাই পরিবার বা স্থানীয় প্রশাসন তাঁকে সরকারি আশ্রয়স্থলে পাঠানোর ঝুঁকি নেয়নি। অন্তঃসত্ত্বাকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি তাঁর স্বামী, জা-ভাশুরও। আচমকা প্রসবযন্ত্রণা উঠলেও যাতে সমস্যা না-হয়, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্তারাও। কাকদ্বীপের বিডিও দিব্যেন্দু সরকার বলেন, ‘‘ওঁর শারীরিক অবস্থার উপরে নজর রাখার জন্য পঞ্চায়েতের স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অ্যাম্বুল্যান্সেরও ব্যবস্থা ছিল, যাতে কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়।’’ তরুণীর জা মৌমিতা দাস বলেন, ‘‘ওঁকে ভয়ে আর অ্যাসবেস্টসের ছাউনির ঘরে রাখিনি।’’ শনিবার সন্ধ্যায় ঝড় শুরু হতেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠেছিল ওঁদের। রান্নার উপায় ছিল না, তাই রাত ৮টার মধ্যে মুড়ি-তরকারি খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন বাড়ির সকলেই। কিন্তু ঘুম আসেনি।
আরও পড়ুন: ১১ প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে বুলবুল, শক্তি খুইয়ে পরিণত গভীর নিম্নচাপে
রবিবার সকালে পঞ্চায়েতের সিনিয়র পাবলিক হেল্থ নার্স ভবানী মাইতি, আশা-কর্মী কৃষ্ণা ভাণ্ডারী দেখতে আসেন অর্চনাকে। চিকিৎসককে দেখিয়ে মা অপর্ণা দাসের সঙ্গে সবে তখন বাড়ি ফিরেছেন অর্চনা। মেয়ে হলে কি বুলবুল নাম রাখবেন? হেসে ফেললেন নবীন দম্পতি। বললেন, ‘‘না, না, এখনও ঠিক করিনি। ঝড়ের বিপদ কেটেছে। এ বার ভেবে নাম ঠিক করব।’’
বকখালি-ফ্রেজারগঞ্জের প্রতিমা মণ্ডলের মাটির ঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে বুলবুল। পরনের কাপড়ও অবশিষ্ট নেই। মিন ধরে দিন চালানো প্রতিমা বললেন, ‘‘নদী, খাল সব ভেসে গিয়েছে। সেখান থেকে কয়েকটা মাছ তুলে এনেছি।’’ ভাঙা রান্নাঘরে বসে সেই মাছ কুটতে কুটতে চোখ ছলছল করছিল সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া কোয়েলের। মেয়ের কান্না দেখে মা প্রতিমা বললেন, ‘‘আধপেটা খেয়ে থাকব। কিন্তু কী পরবে, জানি না।’’
তবে লক্ষ্মীপুরের মৎস্যজীবী সমরেশ সর্দার ভাঙা ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘‘মরণে আর ভয় নেই। ছোট থেকে বাতাসের তাণ্ডব দেখে বুকটা শক্ত হয়ে গিয়েছে।’’ দুপুরের রোদ মিলিয়ে তত ক্ষণে আকাশের মুখ ফের ভার। কিছু দূরেই সমুদ্র। সে-দিকে তাকিয়ে প্রৌঢ় বলেন, ‘‘ভয় হয়। তবে নিজের জন্য নয়। বাচ্চাগুলোর জন্য।’’ যে-ভয় পেয়েছিলেন অনিরুদ্ধ-অর্চনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy