আড়িয়াদহকাণ্ড নিয়ে তোলপাড় রাজ্য-রাজনীতি। —ফাইল চিত্র
আদালত চত্বরে পুলিশি হেফাজতে থাকা শাহজাহান শেখের মতো সেই ‘পাহাড়প্রমাণ ঔদ্ধত্য’ নেই! ছিল না তর্জনী তুলে পুলিশের আগে আগে গটগট করে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টাও! বরং ঠিক উল্টো ছবিই দেখা গেল আড়িয়াদহের জয়ন্ত সিংহের ক্ষেত্রে। গাড়ি থেকে নেমে নিজে থেকেই এক পুলিশকর্মীর হাত ধরে এগিয়ে গেলেন ‘জায়ান্ট’। ঔদ্ধত্য না থাকলেও মুখভঙ্গি নির্বিকারই ছিল তাঁর! ঠিক আগের দিন আদালতে হাজির করানোর সময় যেমনটা ছিল।
আড়িয়াদহে ছেলে ও মাকে রাস্তায় ফেলে পেটানোর অভিযোগে জয়ন্ত ও তাঁর শাগরেদদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বুধবার তাঁদের ব্যারাকপুর আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। বিচারক তাঁদের ছ’দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। এর পর বৃহস্পতিবার জয়ন্ত ও তাঁর সঙ্গীদের সাগর দত্ত হাসপাতালে মেডিক্যাল পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রকাশ্যে আসা ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, হাসপাতাল চত্বরে পুলিশের গাড়ি থামার পর দরজা খুলে নিজেই নামলেন জয়ন্ত। অর্থাৎ, তাঁকে হাত ধরে নামাতে দেখা যায়নি কোনও পুলিশকর্মীকে। জয়ন্ত গাড়ি থেকে নামার পরেই পিছন দিক থেকে এক পুলিশকর্মী এগিয়ে এসে তাঁরা পাশাপাশি হাঁটছিলেন। সেই সময় জয়ন্তই নিজে থেকে ওই পুলিশকর্মীর হাত ধরে নেন। তার পর হাসপাতালে ঢুকে যান তাঁরা। তবে জয়ন্তের চলাফেরায় অস্বাভাবিকতা সেই অর্থে না-থাকলেও খানিক ‘ঔদ্ধত্য’ দেখা গেল তাঁর শাগরেদদের হাঁটাচলায়।
জয়ন্তের ‘আদালত’ তালতলার ক্লাবে এক জনকে চ্যাংদোলা করে লাঠিপেটা করার ভিডিয়ো (আনন্দবাজার অনলাইন সেটির সত্যতা যাচাই করেনি) সোমবার রাতে প্রকাশ্যে আসতেই উত্তাল হয় রাজ্য-রাজনীতি। প্রকাশ্যে আসে জয়ন্তের ‘তৃণমূল-যোগ’। ভিডিয়ো নিয়ে শোরগোল হতেই গ্রেফতার করা হয় জয়ন্ত-সহ ছ’জনকে। পুলিশ জানিয়েছে, ২০২১ সালে আড়িয়াদহের বাসিন্দা রাহুল গুপ্তের বাড়িতে চুরি হয়। তাতে জড়িত সন্দেহে এক যুবক-যুবতীকে তালতলা ক্লাবে নিয়ে এসেছিলেন রাহুলই। জয়ন্তের শাগরেদরা ওই যুবককে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ‘বিচার’ শুরু করেছিলেন। প্রশ্ন ওঠে, কাউকে চোর সন্দেহ হলে, তা খতিয়ে দেখার জন্য তো পুলিশ রয়েছে, তা হলে ক্লাবে কেন আনা হয়েছিল? এরই সঙ্গে বিরোধীদের প্রশ্ন, ‘শাসকদলের ঘনিষ্ঠ’ হওয়ার কারণেই কি এত দিন জয়ন্তের ‘মাতব্বরি’র বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেনি পুলিশ? এ নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সরাসরি আড়িয়াদহ বা জয়ন্ত সিংহের নাম উচ্চারণ না করে তাঁর বক্তব্য, উপনির্বাচনে তৃণমূলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই পুরনো ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
নবান্নের সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও আড়িয়াদহকাণ্ডে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করেছেন। তিনিও স্পষ্ট করে দেন, ঘটনাটি তিন বছর আগের। এক মহিলাকে মারধর করা হচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছিল, তা-ও খারিজ করেন আলাপন। জানিয়ে দেন, নিগৃহীত ব্যক্তি পুরুষই। এ ক্ষেত্রেও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, নিগৃহীত ব্যক্তি পুরুষ হোন বা মহিলা, নিগ্রহের ঘটনাই নিন্দনীয়। এরই সঙ্গে এক জনের লিঙ্গপরিচয় বিকৃত করে ‘অপপ্রচারের’ও নিন্দা করেছেন আলাপন। রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) মনোজ বর্মাও জানিয়েছেন, বাকি অভিযুক্তদেরও অবিলম্বে গ্রেফতার করা হবে।
জয়ন্তকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা না করলে খুন করে দেওয়া হবে, এই মর্মে হুমকি ফোন পেয়েছেন বলে বুধবার দাবি করেছিলেন দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। বৃহস্পতিবার মদন মিত্রও দাবি করলেন, তিনিও হুমকি ফোন পেয়েছেন! আড়িয়াদহের ঘটনা নিয়ে মুখ খোলায় তাঁকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করলেন কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক।
কী বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা
শিল্পপতি মুকেশ অম্বানীর ছেলে অনন্তের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার মুম্বই যাওয়ার সময় মমতা বলেছেন, ‘‘উপনির্বাচনে তৃণমূলকে ড্যামেজ করতেই ৭২ ঘণ্টা আগে থেকে পুরনো ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’ মমতা এ-ও বলেছেন, ‘‘ওই ঘটনা ২০২১ সালের। তখন ওখানে এমপি ছিলেন অর্জুন সিংহ।’’ অর্জুন-অনুগামীদের অবশ্য বক্তব্য, আড়িয়াদহ কামারহাটির অন্তর্গত। আর কামারহাটি পড়ে দমদম লোকসভার মধ্যে। অর্জুন ছিলেন ব্যারাকপুরের সাংসদ। তা হলে কী ভাবে অর্জুনের নাম বলা হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে পুরনো ঘটনা নতুন করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা বলা হচ্ছে না।
কী বললেন আলাপন-মনোজ
আড়িয়াদহের ঘটনায় তিনটি বিষয় ব্যাখ্যা করেন আলাপন। তিনি বলেন, ‘‘এক, আড়িয়াদহের ঘটনা ২০২১ সালের মার্চের। দুই, নিগৃহীত ব্যক্তি পুরুষ। এবং তিন, এই নিয়ে জয়ন্ত সিংহকে গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ বার। ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত তাকে বার বার গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ অনেকের মতে, আলাপন বোঝাতে চেয়েছেন, জয়ন্ত সম্পর্কে ‘পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার’ যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। কোনও কোনও অংশ থেকে বলা হয়েছিল, আড়িয়াদহ তালতলা ক্লাবে চ্যাংদোলা করে যাঁকে পেটানো হয়েছিল, তিনি মহিলা। কিন্তু আলাপন জানিয়েছেন, পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে, নিগৃহীত পুরুষ। তবে যে কোনও লিঙ্গের নিগ্রহই নিন্দার বলে মন্তব্য করেছেন আলাপন। পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘উপনির্বাচনের সময়ে পুরনো একটি ঘটনার লিঙ্গপরিচয় বিকৃত করে যে ভাবে অপপ্রচার করা হয়েছে, তাতে রাজ্য সরকার উদ্বিগ্ন।’’ উত্তর দিনাজপুরের জেসিবি-কাণ্ডের পর আড়িয়াদহের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, স্থানীয় স্তরে পুলিশ কি নিষ্ক্রিয়? কী ভাবে স্থানীয়েরা আইন হাতে তুলে নিয়ে নিজেদের মতো বিচার করছে? এ নিয়ে মনোজ বলেছেন, ‘‘ঠিকই। এটা একটা ইস্যু। এ বিষয়ে আমরা আমাদের ফিল্ড অফিসারদের (যে পুলিশ অফিসারেরা থানা স্তরে কাজ করেন) সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা দিয়েছি।’’ মনোজ আরও বলেন, ‘‘ভাইরাল ভিডিয়োয় যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই তারাও গ্রেফতার হবে।’’
মদনকেও ফোন!
সৌগতের পর এ বার হুমকি ফোন পেয়েছেন বলে দাবি করলেন কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক মদন। তাঁর অভিযোগ, মাঝরাতে তাঁকে হুমকি দিতে ফোন করা হয়েছিল। ফোনের ও পার থেকে তাঁকে বলা হয়, ‘‘তুই বাঁচবি না। কামারহাটিকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলেছিস। তোকে গুলি করে দেব। গুলি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হ।’’ বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমে মদন দাবি করেছেন, বুধবার রাতে তাঁকে অচেনা নম্বর থেকে কেউ ফোন করেছিলেন। পরিষ্কার বাংলায় কথা বলেছিলেন তিনি। ওই ফোনে মদনকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে থানায় এফআইআর দায়ের করতে চলেছেন বলেও জানান মদন। তিনি জানান, ৪৬ সেকেন্ড ধরে ওই অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল। ওই ব্যক্তি তাঁকে খুনের হুমকি দিলেও তিনি ভদ্র ভাষাতেই কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে। মদন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘কে আপনি? এ ভাবে কেন কথা বলছেন?’’ তার সদুত্তর মেলেনি বলে অভিযোগ। এক বার নয়, দু’বার ওই ফোন এসেছিল বলে জানান মদন। দ্বিতীয় বার ফোনটি করা হয়েছিল বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা ৩৮ মিনিটে। তবে মদনের সঙ্গে ওই ব্যক্তির রাতেই এক বার কথা হয়েছিল বলে দাবি। মদন জানান, তিনি ফোন রেকর্ড করতে পারেন না। সেটা তাঁর ব্যর্থতা। কিন্তু ওই ব্যক্তির সঙ্গে কী কী কথা হয়েছে, তা মনে রেখেই বলেছেন তিনি। মদনের কথায়, ‘‘পরিষ্কার বাংলা ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। কোনও বিহারের জেল, কোনও সুবোধ সিংহ বা অর্জুন সিংহ ফোন করেননি। স্থানীয় কেউ ফোন করেছেন। যদিও অর্জুনের মতো কেউ বা কারা যে ফোনের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তা আমি ভালই বুঝতে পেরেছি।’’ এর আগে খুনের হুমকি পেয়েছেন বলে দাবি করেন দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত। মদন সে প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সৌগত রায়কে যেখান থেকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেই ফোনের লোকেশন খুঁজে বার করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। কারণ ওঁকে ফোন করার পরের দিনই আমার কাছে ফোন এল।’’এই ধরনের হুমকি ফোনে যে তিনি ভয় পান না, তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন মদন। বলেন, ‘‘আমি ভয় পাইনি। কারণ, এই ধরনের গুন্ডাদের আমি চিনি। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। তবে পুলিশে এফআইআর করব।’’ প্রাণের হুমকি দিয়ে কে ফোন করলেন মদনকে? কামারহাটির বিধায়ক নিজে বলেছেন, ‘‘আমার কাছে খবর আছে, কামারহাটিতে বহু জায়গায় অর্জুন এবং শুভেন্দু অধিকারী যোগাযোগ করছেন। তাঁরাই এই ফোন করিয়েছিলেন।’’
বাম-কংগ্রেসের থানা ঘেরাও
আড়িয়াদহকাণ্ডের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার কামারহাটি থানা ঘেরাও করে বাম-কংগ্রেস। কামারহাটি, বেলঘরিয়া, আড়িদহের মোট পাঁচটি এলাকা থেকে মিছিল করেন বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা। তার পর থানায় স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সিপিএম নেতা সায়নদীপ মিত্রের দাবি, এর আগে জয়ন্ত এবং তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন বামকর্মীরা থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন, তখন তাঁদেরই পেটানো হয়েছিল। সায়নদীপ ছাড়াও ওই মিছিলে ছিলেন কামারহাটির প্রাক্তন বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায়-সহ অন্যান্য বাম দল ও কংগ্রেসের নেতৃত্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy