প্রথমে চায়ের সঙ্গে নিজের ব্যবহারের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে নিস্তেজ করা, এর পরে ছুরি দিয়ে গলা কাটা। মৃত্যু নিশ্চিত করতে নাইলনের দড়ি দিয়ে গলার দু’দিক থেকে টেনে দেওয়া। গিরিশ পার্ক থানা এলাকার মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের ঘরে পর পর সবটা ১৯ বছরের কৃশপাল সিংহই ঘটিয়েছিল বলে সামনে এসেছে ঘটনার পুনর্নির্মাণে। পুলিশ সূত্রের খবর, খুনের সময়ে এই ঘটনায় আর এক ধৃত করণপাল সিংহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না বলেই দাবি করেছে। যদিও পুলিশ এই সমস্ত বক্তব্যই খতিয়ে দেখছে।
বুধবার রাতেই ধৃতদের নিয়ে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে গিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করে পুলিশ। গিরিশ পার্ক থানার পাশাপাশি ছিলেন ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের তদন্তকারীরাও। গিয়েছিলেন ঘোলা থানার কয়েক জন পুলিশকর্মীও। দেহ ট্রলি ব্যাগে ভরে, ঘোলা থানা এলাকার কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে খেপলির বিলের কাছে ফেলতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় অভিযুক্তেরা। সেই কারণে মুক্তারামবাবু স্ট্রিট থেকে খেপলির বিল পর্যন্ত একাধিক জায়গা ঘুরে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যেই জানা গিয়েছে, ভাগারামের পুরো নাম ভাগারাম দেওয়াসি। তিনি রাজস্থানের জোড়ওয়াল গ্রামের বাসিন্দা। বছর তিন- চার আগে
কলকাতায় এসেছিলেন। মেছুয়া বাজারের কাছে থাকতেন। দুই অভিযুক্তের কাছ থেকে পোশাক কিনে নিয়ে বিক্রি করতেন। সেই সূত্রে মালপত্রের আট লক্ষ টাকা তাঁর বাকি পড়ে যায়। সেই টাকা নিয়েই গোলমালের সূত্রপাত।
পুলিশ জানায়, পুনর্নির্মাণ পর্বে কৃশপালকেই বেশি সক্রিয় দেখিয়েছে। সে-ই দেখিয়েছে, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের কোন ঘরে ভাগারামকে খুন করা হয়েছে। কৃশপাল জানায়, কিছু দিন ধরে সে এই খুনের পরিকল্পনা করছিল। সেই কারণে একাধিক অপরাধমূলক সিরিয়াল ইউটিউবে দেখা শুরু করে। বিভিন্ন সংবাদ পড়ে সেখানে কী ভাবে খুন করা হয়েছে, তা-ও খুঁটিয়ে দেখা শুরু করে কৃশপাল। ঘটনার পুনর্নির্মাণের সময়ে কৃশপাল পুলিশকে জানিয়েছে, সে কিছু দিন ধরে ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করত। ভাগারাম ঘটনার দিন অর্থাৎ, মঙ্গলবার কিছু টাকা শোধ করতে আসেন। সেই সময়ে চায়ের সঙ্গে কৃশপাল নিজের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ায় ভাগারামকে। তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়লে ছুরি দিয়ে গলার নলি কেটে দেয়। রক্ত বন্ধ করতে বিক্রির জন্য রাখা পোশাক দিয়ে গলা চেপে দেয়। তারও পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে নাইলনের দড়ি দিয়ে গলায় দু’দিক থেকে টেনে দেয়। এর পরে আগে থেকেই এনে রাখা ট্রলি ব্যাগের মধ্যে ভাগারামের দেহ ঢোকানোর আগে টেপ দিয়ে হাত-পা এবং মুখ সম্পূর্ণ ঢেকে দেয়। এক সময়ে বাড়ির কাছে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটেই রক্তমাখা পোশাক ফেলে আসে।
এই সময়ে আর এক ধৃত করণপাল কোথায় ছিল? করণপাল ঘটনার দায় চাপিয়েছে কৃশপালের উপরেই। পুলিশ সূত্রের খবর, জেরায় করণপাল জানিয়েছে, ভাগারাম মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাড়িতে আসার আগেই সে ব্যবসার কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় কৃশপাল তাকে ফোন করে জানায়, কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে কিছু পোশাক পৌঁছে দেওয়ার আছে। তাকে নাগেরবাজারে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলে কৃশপাল। যদিও করণপালের এই দাবি পুরো মানতে নারাজ তদন্তকারীরা। তাঁরা সব দিক খতিয়ে দেখছেন। এক পুলিশকর্তা জানান, নিজেকে বাঁচাতে করণপাল এমন দাবি করছে কিনা, দেখা হচ্ছে।
তদন্তে জানা গিয়েছে, বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুরের মধ্যে খুনের ঘটনাটি ঘটে। এর পরে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাড়ি থেকে ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে একটি হলুদ ট্যাক্সিতে নাগেরবাজারে গিয়েছিল কৃশপাল। এখানেই সময় নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশায় রয়েছেন তদন্তকারীরা। কারণ, মুক্তারামবাবু স্ট্রিট থেকে ওই ট্যাক্সি নাগেরবাজারে পৌঁছয় রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ। এইটুকু দূরত্ব পেরোতে আড়াই ঘণ্টা লাগার কথা তো নয়! তা হলে এতটা সময় কী করছিল কৃশপাল? জেরায় কৃশপাল দাবি করেছে, রাস্তায় যানজট ছিল। পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।
তবে আরও একটি সূত্র তদন্তকারীদের এই বিষয়ে ভাবাচ্ছে। তা হল, ভাগারামের ফোন এখনও পাওয়া যায়নি ঠিকই। কিন্তু তাঁর ফোন নম্বর পুলিশের কাছে আছে। সেই নম্বরের টাওয়ারের অবস্থান দেখাচ্ছে, ওই আড়াই ঘণ্টা সময়ের মধ্যে তাঁর মোবাইল ছিল বাবুঘাটের কাছে ফেয়ারলি প্লেসে। তাই পুলিশের সন্দেহ, তবে কি ওই সময়ে কৃশপাল অন্য কোথাও দেহ ফেলার চেষ্টা করেছিল? তাই কি এতটা সময় লেগেছিল মুক্তারামবাবু স্ট্রিট থেকে নাগেরবাজার পৌঁছতে? তদন্তে সেই বিষয়টিও দেখা হচ্ছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)