হরিণশিঙায় প্রচারে সনদী হাঁসদা। ছবি: পাপাই বাগদি।
মহম্মদবাজারের হরিণশিঙায় দেখা মিলল তাঁর। হাতে বাজারের থলে। তাতে প্রচারের কিছু লিফলেট। মলিন, নেতানো শাড়ি পরে হনহন করে হাঁটছেন গ্রামের পরিচিত আশাকর্মী সনদী হাঁসদা। প্রচারসঙ্গী বলতে অদূরে তাঁর স্বামী। সংসারের কাজ সেরে সেই কোন কাকভোরে বেরিয়েছেন। বাড়িতে অপেক্ষায় এক ছেলে, এক মেয়ে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়াবে। ‘একটা বাড়ির এক জন মানুষও যেন বাকি না থাকে’, এটাই তাঁর প্রচারের লক্ষ্য। আদিবাসী অধিকার মহাসভা সমর্থিত নির্দল প্রার্থী সনদীকে তৃণমূল বলছে, ‘দুধভাত’, বিজেপি বলছে, ‘তৃণমূলের সেটিং করা’, আর সিপিএমের কথায়, ‘নেহাৎই দুর্বল প্রতিপক্ষ’। পঞ্চায়েতে জেলা পরিষদের এই প্রার্থীকে প্রথম প্রশ্নই ছিল, এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে এমন পরিশ্রম করে প্রচার চালাচ্ছেন কী ভাবে?
সনদী বললেন, ‘‘এটা নতুন কী? জমি নিয়ে আমাদের আন্দোলনটা বুক দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করছি তো আমরা মেয়েরাই। কিন্তু বরাবর পাল্টা অপমান, তাচ্ছিল্যই মিলছে। ক’দিন আগেই বিনা দোষে মাঝিবাবার (জনজাতিরা তাঁদের মোড়লকে মাঝিবাবা বা মাঝিহাড়াম বলেন)লোকজনের কাছে মারও খেলাম।’’ কিন্তু জনজাতি ভোটে তো গ্রামের ভোটে দিশা দেখান মাঝিবাবারাই। সেখানেও বিরোধিতা? তা হলে এত-যে লড়ছেন, জেতার আশা আছে? এর উত্তরে ওই জনজাতি আশাকর্মী যা বললেন, তা খানিকটা চমকে দেওয়ার মতোই। তাঁর উত্তরের সারমর্ম হল, সব লড়াইয়ে জেতার আশা থাকে না। তবু লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়। ‘‘এই যে জমি বাঁচানোর লড়াই, আমার দলের অনেকেই তো চোখের সামনে সব মেনে নিল, অন্য দিকে চলে গেল। তবু কি হাল ছেড়েছি? হাল ছাড়লে বাঁচব কী ভাবে?’’
তৃণমূলের অন্দরের খেয়োখেয়ি, আর সেই খেয়োখেয়িকে ব্যবহার করেই লড়াইয়ে বিজেপি ও বামেদের মাথা তোলা, এটাই মহম্মদবাজারের পঞ্চায়েত ভোটের মূল ছবি। তারই মধ্যে আদিবাসী মহাসভার সমর্থিত এই প্রার্থী খানিকটা অন্য রং যোগ করেছেন। মহাসভা সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন দু’জন। পঞ্চায়েত সমিতিতে লখীরাম বাসকি এবং জেলা পরিষদে সনদী হাঁসদা। জমি, জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা ভেঙে যখন আদিবাসী অধিকার মহাসভা তৈরি হয়, তখনও কিন্তু তাঁরা ভোটের রাজনীতিতে আসবেন, সে কথা বলেননি। কিন্তু এ বার ভোটে প্রথম প্রার্থী দিয়েছে মহাসভা। আর তা নিয়েই শুরু হয়েছে নানাবিধ চর্চা।
ডেউচা পাঁচামিতে প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্প রূপায়ণে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল এলাকায় বসবাসকারী মানুষের বড় অংশের বিরোধিতা। সরকার পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণার পরেও খনি বিরোধী স্বর জোরালো হয়ে উঠেছিল এলাকায়। আন্দোলন গড়ে উঠেছিল জমি জীবন জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভার নেতৃত্বে। প্রশাসনের তরফে টাকা ও চাকরির শর্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে। ভাঙন ধরে মহাসভাতেও। তৈরি হয় আদিবাসী অধিকার মহাসভা। কারও কারও বক্তব্য, নিজেরা দল ভেঙে বেরিয়ে এলেও এই আদিবাসী মহাসভা এখন ভিতরে ভিতরে প্রশাসনকে সমর্থনের পথেই হাঁটছে। অন্য ভাবে বলতে গেলে,
প্রশাসনেরও অনুচ্চারিত মদত আছে, কারণ তারা মনে করে আদিবাসীদের তরফে ‘ছদ্ম-বিরোধিতা’র বাতাবরণ তৈরি না থাকলে ফের বড়সড় আন্দোলনের জমি তৈরি হতে পারে। বিজেপির বীরভূম সাংগঠনিক জেলার সম্পাদক কৃষ্ণকান্ত সাহা যেমন বললেন, ‘‘যাদের ভোটের রাজনীতিতে আসার কথাই ছিল না, তারা হঠাৎ প্রার্থী দিচ্ছে কেন? ভিতরে ভিতরে তৃণমূলের সঙ্গে যোগসাজশ করে আমাদের ভোট কাটাটাই লক্ষ্য।’’ জমি জীবন জীবিকা প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভাও বিঁধছে আদিবাসী মহাসভাকে। তাদের খোঁচা, ‘‘মহাসভার নাম ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া ওদের আর কাজ কী?’’
তাঁদের ঘিরে এই রটনা সম্পর্কে সনদীকে প্রশ্ন করায় তিনি তাকিয়ে থাকেন কয়েক মুহূর্ত। তার পরে বলেন, ‘‘আমি নিজের কথা বলতে পারি। আমরা মেয়েরা যা আগলাই, সবটাই বুক দিয়ে আগলাই। ছলনা করি না। জোরজবরদস্তি মানিনি, মানবও না।’’ এই একই প্রশ্নের উত্তরে লখীরাম বাসকিও বলেন, ‘‘ও সব কথা গায়ে মাখলে আমাদের চলে না। পাঁচ বছর আগে যখন আমরাই প্রথম প্রতিবাদের পথে হেঁটেছিলাম, আমাদের মাওবাদী তকমা দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনের তরফে। আন্দোলনের গুরুত্ব কমাতে অমন বদনাম রটানো নতুন কিছু নয়।’’
ডেউচা বাসস্ট্যান্ডে বাইক থামিয়ে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েছিলেন আদিবাসী অধিকার মহাসভার নেতা জগন্নাথ টুডু। পরনে হাফ প্যান্ট, টি-শার্ট। মোবাইলে কারও সঙ্গে উত্তেজিত বাক্যালাপ চলছিল। জগন্নাথের গলাতেও এক সুর। ‘‘ভোটের রাজনীতিতে না গেলে আমাদের কথা কেউ শুনবে না, বুঝে গিয়েছি। কিন্তু অবস্থা দেখুন, আমরা একটা অফিস পর্যন্ত খুলতে পারছি না। আগাম টাকা নিয়ে ঘর ভাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পিছু হটেছেন বেশ কয়েক জন। কারণ তৃণমূলের নেতারা তাঁদের শাসিয়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘অনুব্রত মণ্ডলের আমলে দাপাদাপি বেশি ছিল। তখন ভোটে দাঁড়ালে হয়তো আমাদের প্রাণেই মেরে দিত। এখন সেটা না পারলেও আমাদের দমানোর চেষ্টা সব রকম ভাবে চলছে। কিন্তু পাঁচ বছর আগে, যখন সমস্ত বিরোধীদের পুরোপুরি চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছিল, তখনও আমরা, আদিবাসীরাই রুখে দাঁড়িয়েছিলাম, সে কথা ভুললে চলবে না।’’
বস্তুত, পাঁচ বছর আগে পঞ্চায়েত ভোটের আগে অনুব্রত মণ্ডলের দাপটে যখন বিরোধীরা কোথাও মনোনয়নপত্র পেশ করতে পারছিলেন না, তখন এই মহম্মদবাজারেই প্রথম দানা বেঁধেছিল প্রতিরোধ। ব্লক অফিসের সামনে তির-ধনুক হাতে মিছিল করে এসেছিলেন কয়েক হাজার জনজাতি। বিজেপি, বাম, গাঁওতা মিলিয়ে সে ছিল এক সামগ্রিক বিরোধী জোটের জমায়েত। পুলিশও সেই জমায়েত ঠেকাতে পারেনি। পরে এর পিছনে বহিরাগতদের যোগাযোগ, মাওবাদী তত্ত্ব খাটানোর চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বাস্তব হল, গোটা জেলায় অনুব্রতের প্রতাপের বিরুদ্ধে মাথা তোলা সেই আন্দোলন প্রশাসনকে যথেষ্ট অস্বস্তিতেও ফেলেছিল। ভোটে আদিবাসী মহাসভার প্রার্থী দেওয়া কি প্রতিরোধের সেই ধারাবাহিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করল?
এলাকার তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য মুখে এ সব কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁরা বলছেন, ১১ তারিখ ফল প্রকাশের দিনই প্রমাণ হবে, কার কত দম! কিন্তু মহম্মদবাজারের পরিবেশ বলছে, বিরোধীরা এখানে অতীতের তুলনায় অনেক ফুরফুরে মেজাজে। বিজেপি নেতা কৃষ্ণকান্ত যেমন বলছিলেন, ‘‘তৃণমূলের প্রার্থী হওয়া নিয়েই বিস্তর জলঘোলা হয়েছে এখানে। বিক্ষুব্ধ তৃণমূলীরা নিজের দলের প্রার্থীর দেওয়াল লিখনেই গোবর লেপে দিচ্ছে। দোষ হচ্ছে আমাদের। আমরা সে দায় নেব কেন?’’ সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য প্রভাস মাল বললেন, ‘‘অনুব্রতর আমলে পুলিশ-প্রশাসন অন্যায় ভাবে আমাদের নানা মামলায় জড়িয়ে দিত। এখন সেগুলো খানিকটা বন্ধ হয়েছে। পরিবেশ বদলেছে তা-নয়, কিন্তু সন্ত্রাস আগের চেয়ে কিছুটা কমছে।’’ বস্তুত, বিরোধীরা প্রকাশ্যেই বলছেন, অনুব্রতের আমলে যে-নেতারা ধরে আনতে বললে বেঁধে আনতেন, এখন তাঁরাও অনেকটা সংযত। তাঁরাও বুঝে গিয়েছেন, বিপাকে পড়লে বাঁচানোর আপাতত কেউ নেই।
মহম্মদবাজার তাই পাঁচ বছর আগের মতো এ বারেও বীরভূমের ভোট-মানচিত্রে মাথা তুলছে। এলাকার সাধারণ মানুষের বড় অংশ অবশ্য এই ভোটের রাজনীতি নিয়ে অনেকটাই উদাসীন। হরিণশিঙার এক বাসিন্দা যেমন বললেন, ‘‘পুনর্বাসন-পুনর্বাসন বলে গলা ফাটানো চলছে। আমাদের নিজের জায়গা থেকে উপড়ে ফেলে আবার পুনর্বাসন কী? কিন্তু কাকে বলব সে কথা? নিজেদের লাভের জন্য সব দলই আমাদের ব্যবহার করছে।’’
হাবরাপাহাড়ি গ্রামের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘ভাতের হাঁড়ির গায়ে পুরু ধুলো জমে, ঘর ঘরে কাশতে থাকে ছেলেমেয়েরা। রোগজ্বালায় অস্থির সবাই। আমি নিজেও পাথর খাদানে কাজ করতাম। এখন গরু চরানো ছাড়া আর কিছুই পারি না। কিন্তু কোনও দলই সে নিয়ে মাথা ঘামায় না। প্রশাসন তো বরাবরই চুপ। না হলে আর এত অবৈধ পাথর খাদান রমরমিয়ে চলে কী ভাবে?’’ কাশতে কাশতে কথা বন্ধ হয় তাঁর। একটু হাঁপিয়ে নিয়ে ফের বলেন, ‘‘আপনারা তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম, মহাসভার কথা বলছেন। আর আমরা নিজেদের বাঁচার কথা বলছি। যে-ই ক্ষমতায় আসুক, আমাদের জীবনের দাম যে কানাকড়িও নয়, তা বুঝে গেছি।’’
ওই মুহূর্তে ধুলোয় খানিকটা ঝাপসা লাগে ওই যুবকের মুখ। চারপাশটাও।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy