Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Sikkim Flood

নদী তুমি নদীতেই থেকো, আর কারও ঘরে ঢুকো না, কাঁদছেন সন্তান হারানো তিস্তাপারের ‘বাবা’ মুখতার

দুই মেয়ে এবং এক ছেলেকে বাঁচানোই ছিল বাবা মুখতারের একমাত্র লক্ষ। কিন্তু তিনি নিজে বেঁচেছেন, তলিয়ে গিয়েছে সন্তানেরা। ভেসে গিয়েছে গৃহস্থালী। শিলিগুড়ির মুখতারের বর্ণনায় তিস্তাপারের বৃত্তান্ত।

Screen Grab

গাছ আঁকড়ে প্রাণ বেঁচেছে ঠিকই কিন্তু মুখতার হারিয়েছেন সন্তানদের। — নিজস্ব চিত্র।

পার্থপ্রতিম দাস
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ ২০:২৫
Share: Save:

তিস্তার হড়পা বান কেড়ে নিয়েছে সব কিছু। মহম্মদ মুখতার নিজে প্রাণে বেঁচেছেন ঠিকই কিন্তু হারিয়ে ফেলেছেন তাঁর তিন সন্তানকে। হয়তো চিরতরেই। মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে পর দিন দুপুর পর্যন্ত যা ঘটে গিয়েছে, তা চাইলেও কখনও ভুলতে পারবেন না তিনি। এক ছেলের দেহ উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু দুই মেয়ে যে এখনও নিখোঁজ! সব হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে মুখতারের এখন একটাই প্রার্থনা, কোনও অলৌকিকের কৃপায় মেয়ে দু’টো যেন বেঁচে যায়। একই সঙ্গে তিস্তার কাছে প্রার্থনা— নদী তুমি, নদীতেই থেকো। আমাদের ঘরে এসো না। বললেন, ‘‘এমন করে নদী যেন আর কারও ঘরে ঢুকে সব কেড়ে না নেয়। আমি যেন ফিরে পাই আমার দুই মেয়েকে।’’

তিস্তা বিপর্যয়পর্বে ভাইরাল হয়েছিল একটি ছবি। চার দিকে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে একটি বিশাল গাছকে প্রাণপনে জাপটে ধরে রয়েছেন এক ব্যক্তি। সেই ব্যক্তি শিলিগুড়ির মহারাজা কলোনির বাসিন্দা মুখতার। কত ঘণ্টা যে সে ভাবেই থাকতে হয়েছে, এখন আর সঠিক মনে করতে পারেন না। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দুর্যোগের রাতের দুঃসহ স্মৃতির কথা। নিজের সন্তানদের শেষ বার দেখার কথা। নিজে প্রাণে বাঁচলেও চোখের সামনে ছেলেমেয়েদের তলিয়ে যেতে দেখছেন মুখতার।

কর্মসূত্রে স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং এক ছেলেকে নিয়ে সিকিমের রংপোয় থাকতেন শিলিগুড়ির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুখতার। কিছু দিন আগে পর্যন্ত স্ত্রী-ও ছিলেন সঙ্গে। কিন্তু দিন কয়েক আগে স্ত্রী বিহারে বাপের বাড়িতে গিয়েছেন। রংপোর একচিলতে বাড়িতে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকছিলেন মুখতার। পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে তিস্তা। মঙ্গলবার রাতে সিকিমে যখন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে, তখন তিস্তার গর্জন শুনে বিপদের আঁচ পেয়েছিলেন। নদীর শব্দ যেন খানিক আর্তনাদের মতোই পৌঁছেছিল মুখতারের কানে। শোঁ-শোঁ শব্দে যেন লুকিয়ে ছিল অন্য রকম স্বর, আর্ত চিৎকার। বার বার বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে অন্ধকার তিস্তার দিকে চেয়ে বুঝতে চাইছিলেন পরিস্থিতি। একটা সময় যখন নদীর বুক উপচে আশপাশেও ঝড়ের বেগে ঢুকছে ঘোলাজল, আর ঘরে থাকতে চাননি মুখতার। ১৩ বছরের নুরজাহান, ১১ বছরের নুরআইনা এবং ন’বছরের মেহবুবকে কোলে, কাঁধে তুলে বেরিয়ে আসেন টিনের ঘর থেকে। ভেবেছিলেন, প্রাণ যায় যাক, বিপদ যেন সন্তানদের স্পর্শ করতে না পারে! কিন্তু প্রাণটাই রয়েছে, বাকি সব গিয়েছে মুখতারের।

সেই রাতে ঘরের বাইরে এসে দেখেন, তিস্তা ফুলেফেঁপে তারস্বরে গর্জন করছে। জলের স্রোত থেকে বাঁচতে প্রথমেই সবার ছোট, ছেলেকে তুলে দেন বাড়ির টিনের চালে। জল তখন কোমর ছাড়িয়ে বুকের কাছাকাছি। মেয়েদের একটি গাছে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে হাত ফসকে যায়। মুহূর্তের মধ্যে ঘোলাজলের স্রোতে ভেসে যায় দুই মেয়েই। মেয়েদের খুঁজছে যখন অসহায় বাবার চোখ, তখন চোখের সামনে স্রোতে তলিয়ে যায় ছেলেও। কাগজের নৌকার মতো ভেসে যায় মুখতারের টিনের বাড়িটিও। এক লহমায় সব শেষ!

প্রবল বৃষ্টিতে ঘন্টাছয়েক একটি গাছকে আঁকড়ে ধরেছিলেন মুখতার। সেই গাছ, যেখানে দুই মেয়েকে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘটেছিল অঘটন। সকালে উদ্ধারকারী দল এসে উদ্ধার করে। শিলিগুড়িতে নিজের বাড়িতে ফেরান হয় মুখতারকে। বুধবার দুপুর ১২টা নাগাদ মুখতারের ছেলের দেহ উদ্ধার হয়। শিলিগুড়ির কয়েক জন পরিচিত রংপো গিয়ে ছেলের দেহ শিলিগুড়িতে নিয়ে এসে ময়নাতদন্তের পর শেষকৃত্য সারেন। সেই রাতের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন মুখতার। বলছেন, ‘‘জীবনেও ভুলতে পারব না ওই রাতের কথা।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy