Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

নদীও তো বুড়ো হয়েছে, মাছ দেয় না

মহানন্দা থেকে মুখ ফিরিয়েছেন কেন? জগৎ হালদার বলেন, “মা আমাদের জন্ম দিয়েছেন। আর মহানন্দা চালাতেন পেট। এখন আমার মতো হয়তো মহানন্দাও বুড়ো হয়েছে। নদীতে আর জল নেই। তাই মাছও নেই।’’

শুকায়ে যায়: এমনই অবস্থা মহানন্দার, মালদহের আইহোতে। ছবি: তথাগত সেন শর্মা

শুকায়ে যায়: এমনই অবস্থা মহানন্দার, মালদহের আইহোতে। ছবি: তথাগত সেন শর্মা

অভিজিৎ সাহা 
আইহো (মালদহ) শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৯ ০৬:৪৬
Share: Save:

ভাঙাচোরা টালির ঘর। তার উপরে পালা করে সাজানো ‘দোহার’। আর থার্মোকলের বাক্সে বন্দি ‘নাগিন’। ‘দোহার’, ‘নাগিন’ হাতে নিয়েই বছরভর মহানন্দা দাপিয়েছেন আইহো গ্রাম পঞ্চায়েতের মালোপাড়ার জগৎ হালদার। মা-বাবা, ছেলেমেয়ে-সহ ছ’জনের ভরা সংসার চালিয়েছেন। এখন বছর পাঁচেক আর মহানন্দায় নামেননি বছর ষাটের জগৎ। তিন ছেলেও রুজির টানে পাড়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে।

মহানন্দা থেকে মুখ ফিরিয়েছেন কেন? জগৎ হালদার বলেন, “মা আমাদের জন্ম দিয়েছেন। আর মহানন্দা চালাতেন পেট। এখন আমার মতো হয়তো মহানন্দাও বুড়ো হয়েছে। নদীতে আর জল নেই। তাই মাছও নেই।’’ স্মৃতিকথায় তার পরেই উদ্ভাসিত হয় তাঁর মুখ, ‘‘নাগিন জালের ফাঁসে আটকে ছিলাম দু’কেজির ইলিশ। আর এখন সারাদিন মাথা খুঁড়েও মাছ মেলে না। তাই পেট চালাতে মহানন্দা ছেড়ে কাজ করতে হচ্ছে কংক্রিটের।” তাঁর মতোই আর নদীতে জাল নিয়ে নামেন না বছর পঞ্চাশের রাজকুমার হালদার। তিনি বলেন, “বাড়িতে চারটে কলা গাছ রয়েছে। নাগিন, ফাঁসি জাল দিয়ে সেই কলা গাছ ঘিরে রেখেছি। যাতে গবাশি পশু নষ্ট করে না দেয়।”

মালোপাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মহানন্দা। নদী টপকালেই ওপার বাংলা। দু’দেশের সীমান্ত হয়ে এখানে নদী হয়ে উঠেছে বিএসএফের নজরদার স্পিডবোটের গমনপথও। নদীতে নামলেই নিতে হয় বিএসএফের অনুমতি। নামার সময়সীমাও বেঁধে দেয় বিএসএফ। তাই রোজনামচা বদলে গিয়েছে মালোপাড়া, মুচিয়ার গোলাপট্টি গ্রামের বাসিন্দাদের।

মালোপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বিশ্বনাথ হালদার বলেন, ‘‘এই মালোপাড়ার কাছেই তো মহানন্দা ও টাঙনের সঙ্গম। আগে বর্ষার সময়ে প্রচুর ইলিশ মিলত এখানে। কত আর হবে, মাত্র ২৫ বছর আগেও নদীর ধারে ইলিশের হাট বসত।’’

হিমালয়ই মহানন্দার উৎস। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সে বাংলাদেশে ঢুকে মিশেছে পদ্মায়। বর্ষার সময় ফুলেফেঁপে ওঠে মহানন্দা। তবে গরম পড়তেই তার জলস্তর নেমে যায়। তখন ইংরেজবাজার, পুরাতন মালদহে হেঁটেই পাড় হওয়া যায় নদী। একই অবস্থা মুচিয়া, আইহোতেও।

আরও খারাপ অবস্থা চাঁচল-২ ব্লকের মালতিপুরের কাছে। নদীতে জল না থাকায় তা মাঠে পরিণত হয়েছে। তাতেই কিছু কিছু জায়গায় বোরো ধান ফলিয়েছেন মতিউর, সাবির রহমানেরা। তাঁরা বলেন, “নদীতে মাছ ধরতাম। আর নদীর জল দিয়ে সেচের কাজ করতাম। কখনও পাম্প মেশিন বসিয়ে জল কিনতে হয়নি। এখন নদীই শুকিয়ে মাঠ হয়ে গিয়েছে।” তাই মাছ ধরিয়েরা হাত লাগিয়েছেন চাষের কাজে। হাত পাকিয়েও ফেলেছেন অনেকটা।

জল নেই, গতিও নেই মহানন্দার। কেন এমন অবস্থা? নদী বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, “মানিকচকে ফুলহার নদী এসে মিশেছে মহানন্দা। স্ল্যুইসগেট থাকায় জল আটকে দেওয়া হয়েছে। বাঁধ দিয়ে নদীর গতি আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে গভীরতা কমেছে মহানন্দার।”

জল কম থাকায় মাছের পরিমাণও কমছে, মনে করেছেন তাঁরা। নদী বিশেষজ্ঞদের আরও দাবি, “গরমে শহর এলাকায় মহানন্দা নালাতে পরিণত হয়েছে। নদীতে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় নদীয়ালি মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।” মালদহ জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ সরলা মুর্মু বলেন, “নদীয়ালি মাছের জোগান বাড়াতে মহানন্দায় মাছ ছাড়া হয়। তবে গরমে নদীতে জল না থাকায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের প্রশাসনিক স্তরের ভাবনা-চিন্তা চলছে।” তাতেও কি শেষরক্ষা হবে, প্রশ্ন থাকছেই।

অন্য বিষয়গুলি:

River Mahananda
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE