পাটগাছ থেকে সুতলি ছাড়াচ্ছেন গ্রামবাসী। নিজস্ব চিত্র
প্রচণ্ড গরম, সঙ্গে চড়া রোদ। রোদ থেকে বাঁচতে বাড়ির অদূরে জলাশয়ের ধারে মাটিতে ছাতা পুঁতে সেটির নীচে বসে এক গোছা পচা পাটগাছ থেকে টেনে সুতলি বার করার কাজে ব্যস্ত আব্দুল লতিব।
উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের কাশিমপুর এলাকার ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা আব্দুল লতিবের কাছে ‘স্বাধীনতা দিবস’ আলাদা অর্থ বয়ে আনে না। তাঁর কথায়, ‘‘করোনার বাড়াবাড়িতে গত দু’বছর দিনমজুরির কাজ মেলেনি। ধান-পাটের ন্যায্য দাম পাইনি। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। সংসারের আর্থিক সঙ্কট সামলাব, না স্বাধীনতা দিবস নিয়ে ভাবব!’’
আব্দুলের কিছুটা দূরে বসে, পচা পাটগাছ থেকে সুতলি বার করছিলেন ওই এলাকারই বাসিন্দা তারিকুল হোসেন নামে এক তরুণ। প্রতি বছর ১৫ অগস্ট এলাকায় স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়? তারিকুল বললেন,‘‘হাসালেন দাদা। সংসারের হাল ধরতে বেশ কয়েক বছর আগে পড়াশোনা ছেড়েছি। আশপাশের স্কুলে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা ওঠে। তা ছাড়া, এ নিয়ে এলাকায় মাতামাতি নেই। পেট চললে, তার পরে না স্বাধীনতা দিবস পালন!’’
‘জামাত উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’(জেএমবি) জঙ্গিগোষ্ঠীর হয়ে নাশকতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে মালদহের সামসি থেকে কাশিমপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল বারি নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। পরে, একই এলাকা থেকে একই অভিযোগে আব্দুলের সঙ্গী নিজামুদ্দিন আহমেদ নামে আর এক যুবককেও ধরা হয়।
নিজামুদ্দিনের বাড়ি ইটাহারের দুর্গাপুর পঞ্চায়েতের গাজিয়ার এলাকায়। দেশদ্রোহিতার মামলায় অভিযুক্ত ওই দুই যুবক এখনও জেলে রয়েছেন। আব্দুল গ্রেফতার হওয়ার পরে, তাঁর স্ত্রী দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরে বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। মালদহে চলে গিয়েছেন মা। তবে গ্রামেই থাকা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক নিজামুদ্দিনের স্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘স্বামী গ্রেফতার হওয়ার পরে, শ্বশুরবাড়ির আর্থিক সহযোগিতায় দুই মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চলছে।’’
গাজিয়ারে নিজামুদ্দিনের বাড়ির অদূরে একটি চায়ের দোকান রয়েছে। নিজামুদ্দিনের প্রতিবেশী মহম্মদ আলি, ওয়াহেদ আলি, রাজু মহম্মদ ওই দোকানে বসে পরিচিতদের সঙ্গে আড্ডা মারছিলেন। ওয়াহেদ বলেন, ‘‘এলাকায় দিনমজুর, কৃষক, ভ্যানচালক, খেতমজুরদের বসবাস বেশি। কাজ ফেলে কারও স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করার সময় নেই। কারণ, কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার উপায় নেই।’’
দুই গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ছ’হাজার পরিবারের বাস। অধিকাংশ নিরক্ষর। হাজার দু’য়েক পরিবার নিজস্ব জমিতে কৃষিকাজ করে সংসার চালায়। বাকিরা দিনমজুরি, খেতমজুরি, আনাজ ও মাছ বিক্রি করেন, ভ্যানরিকশা চালান। অনেকেই সরকারি প্রকল্পের ঘর ও একশো দিনের কাজ পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে দু’গ্রামেই।
ইটাহারের বাসিন্দা, বিজেপির জেলা সভাপতি বাসুদেব সরকারের দাবি, ‘‘শুধু ওই দুই গ্রাম নয়, ইটাহারের সমস্ত পঞ্চায়েতের বেশির ভাগ গ্রামবাসী কেন্দ্র সরকারের আবাস, স্বনির্ভরতা, একশো দিনের প্রকল্প-সহ বেশির ভাগ প্রকল্পের সুবিধা পাননি। কিছু তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ সে সব সুবিধা পেয়েছেন।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল ও রাজ্য সরকারের দুর্নীতির জেরেই গরিব মানুষের এমন পরিস্থিতি।’’ ইটাহারের তৃণমূল বিধায়ক মোশারফ হোসেনের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘বিজেপি সব ক্ষেত্রেই তৃণমূল ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। ইটাহারের সমস্ত পঞ্চায়েতে রাজ্য সরকারের তরফে সমস্ত স্তরের মানুষকে সমস্ত সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কোথাও সমস্যা থাকলে, দেখা হবে।’’
তবে কাশিমপুর বা গাজিয়ার, ‘জঙ্গি-বিরোধিতায়’ সবার এক সুর। কাশিমপুরের গৃহবধূ নীলুফা খাতুনের বক্তব্য, ‘‘আব্দুল প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি চালানোর নামে জঙ্গি গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করত বলে শুনেছি। যদি সেটা সত্যি হয়, তা হলে দেশদ্রোহের অপরাধে ওর সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া জরুরি।’’ আর গাজিয়ারের বাসিন্দা দিনমজুর আইনু মহম্মদ বলেন, ‘‘নিজামুদ্দিন গ্রামীণ চিকিৎসকের কাজের আড়ালে যদি জঙ্গিদের হয়ে কাজ করে থাকে, তা হলে রাষ্ট্র ওকে কঠোর শাস্তি দিক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy