গুরুপদ।
হাতে চালানো তাঁতের ‘টানার’ সুতোয় মাকুর ‘পোড়েন’ থামিয়ে সে গেয়ে উঠল, “অবাক পৃথিবী তোমায় প্রণাম। এই তোমার কোলে এসে ব্যথা যে পেলাম...”।
দরাজ গলার টানে টিনের তাঁতঘরের জানলায় বিস্মিত মুখের ভিড়। মুখচোরা মানুষটা এমন করে গাইতে পারেন? পড়শিরা অবাক।
ছোট থেকেই সুরের টান গুরুপদর। তখন কত-ই বা বয়স, সাত কী আট। পাড়ার অন্য ছেলেরা যখন ঘুড়ি লাটাই, ডাংগুলি বা ফুটবল নিয়ে তোলপাড় করছে। ছোট্ট গুরুপদ তখন সুযোগ পেলেই হাজির কীর্তনের আসরে। গায়ক-বাদকদের গা ঘেঁষে বসে থাকা ছেলেটার নজর থাকত জুড়ি বাজানোর দিকে। ফুরসৎ পেলেই হাতে তুলে নিত খঞ্জনি। ওই বয়সেও তুখোড় বাজাতেন। এক সময়ে আসরের বেশ পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে বালক। জুড়ি বাজানোর জন্য ডেকে নিতেন কীর্তনিয়ারা। সুরের সরণি বেয়ে সেই যাত্রা শুরু গুরুপদ বিশ্বাসের।
নবদ্বীপে দক্ষিণ প্রান্ত যেখানে বর্ধমানে মিশেছে, সেই প্রফুল্লনগরে রেল লাইনের ধারে বাস। ব্যান্ডেল-কাটোয়া শাখার ওই রেল লাইনটাই বড় সুরেলা। রেল লাইনের এ পারে নদিয়া কীর্তনময়। ও পারের বর্ধমানের মাটিতে ভেসে বেড়ায় লোকগান। লাইনের ও পার গুরুপদকে নেশার মতো টানে। ওখানেই পরীক্ষিৎ বালার বাস। ওখানেই গান গেয়ে থাকেন শুকলাল মিস্ত্রি—‘গুরু না ভজি মুই সন্ধ্যা সকালে মন প্রাণ দিয়া রে’। পুজো মণ্ডপের মাইকে বাজে গোষ্ঠগোপাল। এ দিকে সূর্য ডুবলে বাড়ি ফিরে পালাকীর্তনের আসর। আখরে-দোহারে মাখামাখি রাত।
গানপাগল গুরুপদ তত দিনে ঠিক করে ফেলেছেন গানই গাইবেন। কিন্তু গুরু না ভজলে গান হবে কী করে! মনে পড়ে গেল ভরতদাস বাউলের কথা। রেলপাড়ের বাসিন্দা ভরত দাস গান গেয়ে হিল্লি-দিল্লি করে বেরান। বেশ ক’দিন ঘুরে এক দিন দেখাও হল। ভরত দাস জানালেন, শেখাতে পারেন। তবে বাড়ির অনুমতি লাগবে। তা-ও মিলল। শুরু হল নিয়ম মেনে শেখা। বেশি দিন লাগল না। তৈরি জিনিস অল্প ছোঁয়াতেই সম্পূর্ণ হয়। তিন মাসের মধ্যে গুরুর হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন গুরুপদ। রাতের পর রাত গান আর গান। মালদহ থেকে মেদিনীপুর, কাকদ্বীপ থেকে করিমপুর। এক মঞ্চ থেকে অন্য মঞ্চে।
কিছু দিন এ ভাবে কাটার পর বোঝা গেল গান গেয়ে নাম হচ্ছে বটে, কিন্তু রোজগার নেই। ভরতদাস বাউল মানুষ, তাঁর সঙ্গে কি আর গৃহস্থের হিসাব মেলে? তত দিনে যে ঘর-সংসার হয়েছে তাঁর।
এখন দিনভর তাঁত বুনতে ব্যস্ত গুরুপদ। বলেন, “জানেন, নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলাম গান থামিয়ে দিতে। খেয়ে-পড়ে বাঁচতে হবে তো।” সুতো, তানা, মাড়, পালিশ, মহাজনের দাদন নিয়ে ডুবে থাকা গুরুপদর কাছে গান এখন অনেক দূরের আকাশ।
তিনি বলেন, “বাইরে যাওয়া বন্ধ করে স্থানীয় ভাবেও কিছু দিন চেষ্টা করেছি। সুবিধা হয়নি।”
সংসারে নাজেহাল গুরুপদর মনে পড়ে গুরুর কাছে শেখা গানের কলি— “আমি যত করি ভাবনা, কিছুই আমার হল না এই ভূতের বোঝা মাথায় করে দিন কাটালাম...”।
নবদ্বীপ পুরসভার চব্বিশ নম্বর ওয়ার্ডকে যেখানে ছুঁয়েছে রেললাইন, সেখানে দুই সন্তান নিয়ে আস্তানা গুরুপদর। কয়েক মাস বয়সের ছোট সন্তানটি জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। এখন তাকে নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা। নিঝুম দুপুরে ঝমঝমিয়ে ছুটে যায় রেলগাড়ি। কেঁপে ওঠে গুরুপদ আর তার তাঁতঘর।
চাকার শব্দ মিলিয়ে যেতেই সুর জাগে হারিয়ে যাওয়া লোকগায়কের গলায়— “লাগে না ফুলচন্দন, তন্ত্রমন্ত্র লাগে না। গানই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy