প্রতীকী ছবি।
সামনে মাটির হাঁড়িকুড়ির দোকান। পিছনে দু’টি ঘর ভাড়া নিয়ে কয়েক জন শিক্ষক ব্যাচ করে কোচিং সেন্টার চালাতেন। করিমপুর শহর ছাড়াও দূর থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসত। কোচিং সেন্টারের দরজায় যে তালা ঝোলে, তার চাবি দড়িতে ঝোলানো থাকত। যখন যাদের পড়া থাকত, তারা এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকত।
হাঁড়িকুড়ির দোকান-মালিক কালী পালই বাড়ির মালিক। বৃহস্পতিবার কালী জানান, তিনিই প্রথম বেড় রামচন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী নূপুর খাতুনকে কোচিং সেন্টারের ঘরে সিলিং ফ্যান থেকে ওড়নার ফাঁসে ঝুলে থাকতে দেখেন। তার পকেটে ‘সুইসাইড নোট’ পাওয়া গেলেও সেটি নূপুরেরই হস্তাক্ষর কি না, বিশেষজ্ঞেরা পরীক্ষা করার আগে পুলিশ নিশ্চিত হতে পারছে না।
কালীর কথা অনুযায়ী, সোমবার সকালে ঘর থেকে দোকানে যাওয়ার সময়ে তিনি দেখেন, কোচিং সেন্টারের দরজায় তালা নেই। আলতো করে ভেজানো। বাইরে এক জোড়া চপ্পল রয়েছে। দুপুর আড়াইটে নাগাদ আবার দোকান থেকে ফেরার সময়েও একই ভাবে ভেজানো দরজার সামনে সেই চপ্পল পড়ে থাকতে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। দরজা একটু ঠেলে মুখ বাড়িয়ে তিনি চমকে ওঠেন। তাঁর চিৎকারেই আশপাশের সকলে ছুটে আসেন।
দুপুর ৩টে নাগাদ পুলিশ নূপুরের দেহ নামিয়ে ময়নাতদন্তে পাঠায়। এর পরেই বেড় রামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকে নূপুরের সহপাঠী ও তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া একটি ছেলেকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে থাকে। জানা যায়, সকালে সে-ও করিমপুরে কোচিং সেন্টারে পড়তে গিয়েছিল। কোনও কিছু নিয়ে দু’জনের মনোমালিন্য হয়। রাতে নূপুরের মা ছেলেটির বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ জানালে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
নূপুরের মায়ের অভিযোগ, ছেলেটি তাঁর মেয়েকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। মেয়ে রাজি না হওয়ায় খুনের হুমকিও দেয়। এই নিয়ে গোলমালের জেরেই সে নূপুরকে খুন করে ঝুলিয়ে দিয়েছে। যদিও ছেলেটির বাড়ির লোক তা মানতে রাজি নন। তাঁদের প্রশ্ন, মাত্র দু’মাস পরে যেখানে দু’জনেরই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, সেখানে বিয়ে নিয়ে এখন মাথাব্যথা হবে কেন? তা ছাড়া ঘটনা যখন ঘটে বলে আন্দাজ করা যাচ্ছে, তার আগেই ছেলেটি প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল বলে পরিবারের দাবি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের একাংশ জানাচ্ছে, পাখার ব্লেডে বাঁধা কালো ওড়নার ফাঁসে নূপুরের দেহ ঝুলছিল। পা মাটিতে লটকে ছিল। প্রায় এক ফুট দূরে প্লাস্টিক চেয়ারে আর পায়ের কাছে পড়ে ছিল বইয়ের ব্যাগ আর চাদর। অনেকেই সন্দিহান, ছাত্রীর পা মাটিতে ঠেকে থাকলে আত্মহত্যায় মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারেরা জানাচ্ছেন— আত্মহত্যার ক্ষেত্রে এক) গলার সব দিকে সমান ভাবে ফাঁসের দাগ থাকে না, যা শ্বাসরোধ করে মারলে থাকে। দুই) পায়ের পাতা মাটির দিকে ঝুলে যায়। তিন) বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মল বা মুত্রত্যাগের সম্ভাবনা থাকে। ৪) জিভ মুখের বাইরে না বেরোলেও দাঁতে চাপা অবস্থায় থাকে। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, নূপুরের দেহ সুরতহালের সময়ে কিছু লক্ষণ মিলেছে। তবে তার পা মাটিতে লটকে থাকায় পাতা আদৌ ঝুলে ছিল না।
ছেলেটির পরিবারের দাবি, সে দিন সে সাড়ে ১০টা নাগাদ বাড়ি ফিরেছিল। তাঁদের প্রশ্ন, এক) যেখানে দু’জনের ঝগড়া হয়েছে, পড়া শেষের পরে নূপুর ছেলেটির সঙ্গে একা ওই ঘরে যাবে কেন? দুই) ঘরটি এতই জনবহুল এলাকায় একটু জোর শব্দ হলেই সকলে শুনতে পাবে। সেখানে এক জনকে নিঃশব্দে খুন করে টাঙিয়ে দেওয়া ‘পেশাদার খুনি’ ছাড়া কারও পক্ষে কি সম্ভব? আবার নূপুর যদি আত্মহত্যাই করবে, সে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ না-করে ভেজিয়ে রাখবে কেন, উল্টো দিকে সেই প্রশ্নও উঠছে। আপাতত কৃষ্ণনগরের হোমে থাকা ছেলেটিকে শনিবার ফের জুভেনাইল কোর্টে তোলা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy