E-Paper

দেওয়াল জুড়ে টাঙানো আবছা তেলরঙের ছবি

আব্দুস সামাদের জন্ম উনিশ শতকে। সাতের দশকের একেবারে গোড়ায়। বীরভূম জেলার শাসপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে।

স্বাধীনতা দিবসের জন্য পতাকা-সহ নানা সামগ্রীর পসরা। কালনায়৷ ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

স্বাধীনতা দিবসের জন্য পতাকা-সহ নানা সামগ্রীর পসরা। কালনায়৷ ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

আব্দুল কাফি, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৩ ০৭:২২
Share
Save

খুব সোঁদা গন্ধওয়ালা এক বইঠাসা ঘরের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো থাকত একটি আবছা তেলরঙের ছবি। বুকের কাছে ভাঁজ করা হাতে একটি বই ধরা আছে, চোয়াল বেশ শক্ত, উকিলের কালো পোশাক পরা এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকেন সেই ছবিতে। ছোট্ট একটি নড়বড়ে পড়ার টেবিলের ওধারে বসে আছেন রেজাউল করিম। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তায় সেই শৈশবে জেনেছি, বেশ নামজাদা লোক, ছবির ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটি—কী রকম যেন এক আত্মীয় আমাদের, দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন এক কালে।

স্বাধীনতা সংগ্রামী? বাঘা যতীনের মতো? ক্ষুদিরাম কিংবা বিনয় বাদলের মতো? না, তেমন নন ঠিক। গান্ধীজির অনুগামী। নেতাজির কথা শুনেছ তো? নেতাজি সুভাষের সঙ্গেও জানাশোনা ছিল। এক সময় সুভাষচন্দ্রও এসেছেন ওঁর কাছে। স্বাধীনতার কর্মীরা এককালে ভরিয়ে রেখেছিলেন ঘর। কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য এই জেলার মানুষজনকে এককাট্টা করতে গেলে কী কী পদক্ষেপ জরুরি তা নিয়ে চর্চা হয়েছে এই ঘরে।

জেলার হিন্দু-মুসলমান—দুই ধর্মের মানুষ যাতে একে অন্যকে ভুল না বোঝে, যাতে একে অন্যকে শত্রু না মনে করে, স্বাধীনতা আনবার যুদ্ধে যাতে নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত না হয়—তার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা করেছেন ছবির ওই ব্যক্তি। আমাদের বহরমপুরে এই যে বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে, আগে যাকে বলা হত ডেভিস রোড—এই রাস্তা এখন ওঁর নামেই। আব্দুস সামাদ রোড। ওই বিবর্ণ ছবির লোকটি আব্দুস সামাদ। মুর্শিদাবাদ জেলার কংগ্রেস দলের সভাপতি ছিলেন বহু দিন। দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন। উনি স্বাধীনতা সংগ্রামী।

ইতিহাসের ছাত্রপাঠ্য কিংবা অছাত্রপাঠ্য কোনও বইতেই ওঁর নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাঝে মাঝে অবশ্য এক-আধ বার কোনও কোনও খুচরো নিবন্ধে কতকটা পার্শ্বচরিত্রের মতো চলকে ওঠে তাঁর নাম—বিশেষত মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাসচর্চার সূত্রে কিংবা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিশ শতকের মুসলমান বাঙালির যোগদান কী ভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করেছিল, অসূয়া-সন্দেহ-অবিশ্বাসের বিরোধিতায় তৈরি করার চেষ্টা করেছিল একটি সম্প্রীতির বয়ান—তা নিয়ে লিখতে গিয়ে আব্দুস সামাদের ভূমিকার কথা এক-আধ বার এসে পড়ে বইকি।

আব্দুস সামাদের জন্ম উনিশ শতকে। সাতের দশকের একেবারে গোড়ায়। বীরভূম জেলার শাসপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। অনেকগুলি ভাইবোনের সঙ্গে নিতান্ত অর্থসঙ্কটে শৈশব ও বাল্যকাল কাটিয়ে কী ভাবে যে তিনি জেদ আর অধ্যবসায়ে ভর করে কলকাতা এসে পৌঁছেছিলেন উচ্চতর পড়াশোনার লক্ষ্যে, কী ভাবে ওকালতি পাশ করেছিলেন এবং আরও কিছু পথ পার করে অবশেষে বহরমপুর আদালতে শুরু করেছিলেন কর্মজীবন তার কোনও লিখিত বিবরণ আজ আর নেই। কিন্তু তা যে রূপকথার মসৃণতায় ঘটেনি এ কথা বলাই যায়। সম্ভবত মহাত্মা গান্ধীর কর্মকাণ্ডই তাঁকে দেশের কাজে টেনে নিয়ে এসেছিল।

দেশপ্রেমিক সামাদের বুঝতে দেরি হয়নি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজন স্বাধীনতা আন্দোলনের শত্রু। ফলে গোড়া থেকেই মুসলিম লিগের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি বিরাগ ছিল তাঁর। ১৯২৯ সালে লিগ-রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেই মুর্শিদাবাদ থেকে তিনি বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। নানা লেখায় ও বক্তৃতায় ধারাবাহিক চেষ্টা করে গিয়েছেন আব্দুস সামাদ—দেশ স্বাধীন করার লড়াইতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন কী ভাবে চরম বাধা তৈরি করে দেবে তা বোঝাতে। বিধান পরিষদের সদস্য থাকাকালীন বারবার তুলে ধরেছেন মেয়েদের, বিশেষত মুসলিম মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে সরকারি ভূমিকা কেন নিতান্ত অপ্রতুল, কী ভাবে তা বাড়ানো দরকার। সেই তিনের দশকে।

ধর্মের ভিত্তিতেই ভোটাররা তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধি স্থির করবেন—হিন্দু ও মুসলিম ভোটারদের জন্য আলাদা আলাদা প্রার্থী থাকবে নির্বাচনে—ব্রিটিশ শাসকের এই পদ্ধতির বিরোধিতায় ১৯৪০ সালে গড়ে উঠেছিল অ্যান্টি সেপারেট ইলেকটরেট লিগ। তার সম্পাদক ছিলেন মইনুদ্দিন হোসায়েন। আর সভাপতির ভূমিকা ছিল আব্দুস সামাদের। সেই সংস্থার আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন রাধাকৃষ্ণন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, হুমায়ুন কবিরের মতো মানুষজন। সামাদ ও তাঁর বন্ধুরা প্রাণপণে বলার চেষ্টা করে গিয়েছেন, অপর সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ কার্যত নিজের সম্প্রদায়ের ক্ষতিই করে। মুসলিম লিগের সম্প্রদায়প্রীতি আসলে যে মুসলমান সমাজের উন্নতির সহায় হবে না, কেবলমাত্র অন্য ধর্মের লোকের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাস জিইয়ে রাখবে, পিছন দিকে টেনে রাখবে সর্বদা—তাঁর লেখায়, বক্তৃতায় এ কথা বারবার এসেছে।

১৯৩১ সালে পরিষদের একটি বক্তৃতায় তিনি জোরের সঙ্গে বলার চেষ্টা করেছিলেন, ‘‘হিন্দুরা সব দেবদূত নয়। সাধারণ মানুষ। অন্য যে কোনও ধর্মের মানুষের মতো তাদেরও নানা মানবিক ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই কোনও কোনও স্বার্থপর হিন্দু ব্যক্তির উদাহরণ দেখিয়ে সামগ্রিক হিন্দুসমাজকে শত্রু চিহ্নিত করা চূড়ান্ত বিকার।’’ মুর্শিদাবাদ জেলার যুবসমাজের কাছে দেশের জন্য দায়িত্ববোধ এবং ভালবাসার অনুভূতি গড়ে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না তাঁর। সম্প্রীতি ও মিলন সম্ভাবনা প্রসারিত করার আহ্বান তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন—বিশেষ করে নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে। হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা ব্যতিরেকে দেশের কাজ, দেশের স্বাধীনতা আসবে না—এই ছিল তাঁর আমরণ বিশ্বাস।

দেশের স্বাধীনতার কাজে জীবনের বৃহদংশ ব্যয় করেছেন, এমন অনেক মানুষের কথাই দেশের সব মানুষ জানেন না। কিন্তু দেশের মানুষ সারা জীবন স্মরণ করবেন—এই আকাঙ্ক্ষায় তো আর স্বাধীনতার কাজে তাঁরা নামেননি। আব্দুস সামাদ স্বাধীনতা আসার কয়েক বছর আগেই মারা যান। স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের চারাগাছ বেশ ডালপালা মেলে বেড়েও উঠেছে আজ। আব্দুস সামাদ এখন বহরমপুরের বহু পুরাতন একটি রাস্তার নামের সঙ্গেই শুধু জুড়ে আছেন। তাঁর ওই রংচটা তৈলচিত্রটিরও কোনও খবর জানি না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

independence day Indian tricolour Har Ghar Tiranga

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।