—ফাইল চিত্র।
গতির সঙ্গে কি বেগের কোনও সম্পর্ক আছে?
উত্তরটা তাঁরাই জানেন যাঁরা ট্রেনের গতি ভুলে গোটা যাত্রাপথে শুধু বেগটাকেই আপ্রাণ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন!
কিন্তু সে তো আর যে সে ব্যাপার নয়। রীতিমতো অসাধ্য সাধন। কেউ কেউ হয়তো পারেন। আর যাঁরা পারেন না? তাঁরা বিড়বিড় করেন, ‘হায় রে পেট, তোর জন্যই মাথা হেঁট।’
ব্যাপারটা ভাবুন এক বার। সাঁ সাঁ করে ট্রেন ছুটছে। জানলার বাইরে সরে সরে যাচ্ছে গাছপালা, সবুজ মাঠ, রেলগেট। এলোমেলো হাওয়া উড়িয়ে দিচ্ছে চুল। দূরের গরুগুলোকে ছাগল আর ছাগলগুলোকে নেই মনে হচ্ছে। কানের পাশ দিয়ে একের পর এক ফিরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে, ‘চায়ে গরম...বাদাম...ঝালমুড়ি...কচি শসা...।’ আর আপনি অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছেন। সে ভাবে কিচ্ছুটি দেখছেন না। কানেও ঢুকছে না কিছুই।
কখনও ভাবছেন, অতীতের কোনও দুঃখ-যন্ত্রণার কথা। কখনও মনে করার চেষ্টা করছেন প্রিয় কোনও স্মৃতি। যাতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ইয়ে ব্যাপারটা ভুলে থাকা যায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বাঙালি বেগ আর আবেগ কবে ঠিকঠাক সামাল দিতে পেরেছে!
কেউ কেউ বলেন, ট্রেনের দোলা নাকি ছেলেবেলায় মায়ের কোলের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আর সেই কারণেই নাকি ট্রেনে ভাল ঘুম হয়। তাঁদের উপর তখন কেমন রাগ হয়, বলুন তো? ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমটুম তো দূরের কথা, গতির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে বেগ। আর তা চাপতে গিয়ে সে কী দুর্গতি! মনে মনে শুধু বলছেন, ‘কত দূর আর কত দূর বলো মা?’
কিন্তু মা আর কী বলবেন? যা করার তা তো করেই রেখেছে রেল দফতর। লালগোলা-শিয়ালদহ (প্রায় ২২৭ কিলোমিটার) শাখার মেমু (মেনলাইন ইলেকট্রিক্যাল মাল্টিপল ইউনিট) বা ডিএমইউ (ডিজেল মাল্টিপল ইউনিট) এ শৌচাগার নেই। রেলের যুক্তি, ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বের বেশি লোকাল ট্রেন গেলেই প্রতি দু’ঘণ্টায় একটি স্টেশনে বেশ কিছুক্ষণ ট্রেন থামানো হবে। যাতে যাত্রীরা জল সংগ্রহ করতে পারেন বা চাপমুক্ত হতে পারেন। যাত্রীদের প্রশ্ন, ‘‘১৫০ কিলোমিটার মধ্যে যে কারও ইয়ে পাবে না, সে ব্যাপারে রেল কর্তৃপক্ষ কী ভাবে নিশ্চিত হলেন?’’
কথাটা ফেলনা নয়। ট্রেন মানেই তো ‘শুধু যাওয়া আসা’, শুধু ভিড়ে ভাসা নয়। সেখানেও হাসি-কান্না-ইয়ে পেতেই পারে। দূরে কোথাও যাওয়ার কথা শুনলেই ‘যাই, একটু হালকা হয়ে আসি’ বলা বাঙালির সংখ্যাও কিন্তু মোটেই হাতেগোনা নয়! তা হলে?
তা হলে আর কী! সব জেনেও উঠতে হয় শৌচাগারহীন ট্রেনে। লালগোলা কিংবা শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ছাড়ার পরে কৃষ্ণনগরে এসে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। সেই সময় জলযোগ কিংবা জলবিয়োগ করতে হয়। প্রয়োজনে ইয়েও। তার পরে সব সেরে ফের ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্রায়ই বিপত্তি ঘটে। কখনও ট্রেন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কখনও লোটাকম্বল নিয়ে দৌড়চ্ছেন কেউ। কেউ আবার টাল সামলাতে না পেরে প্ল্যাটফর্মে ধপাস। নেপথ্যে কারা যেন আউড়ে যাচ্ছে—‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি/ যদু মাষ্টার শ্বশুরবাড়ি।/রেল কাম ঝমাঝম্ /পা পিছলে আলুর দম।’
কী, অখিলচন্দ্র সেনের কথা মনে পড়ছে তো?
অখিলচন্দ্র তখন নব্যশিক্ষিত যুবক। নতুন জামাইও বটে। শ্বশুরবাড়ি থেকে পাকা কাঁঠাল খেয়ে ফিরছিলেন ট্রেনে। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। গুরুপাক কাঁঠাল যে এমন বিপাকে ফেলবে, কে জানত! এ দিকে চতুর্থ শ্রেণির কামরাতেও কোনও শৌচাগার নেই। তা হলে উপায়? প্রকৃতির ডাককে উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি লোটা নিয়ে নেমে পড়েন আমেদপুর স্টেশনে। মুক্তি পেতে সটান দৌড় দেন প্ল্যাটফর্মের শৌচাগারে। ঠিক তখনই ছেড়ে দেয় ট্রেন।
ব্যস! ইয়ে সেরে তড়িঘড়ি বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরতে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপরে ধপাস!
রেগে গিয়ে অখিলচন্দ্র সটান সাহেবগঞ্জ ডিভিশনাল রেলওয়ে অফিসে দিলেন চিঠি পাঠিয়ে—(‘Beloved Sir, I am arrive by passenger train Ahmedpur station and my belly is too much swelling with jackfruit. I am therefore went to privy. Just I doing the nuisance that guard making whistle blow for train to go off and I am running with lotah in one hand and dhoti in the next...This too much bad, if passenger go to make dung that dam guard not wait train five minutes for him. I am, therefore pray your honour to make big fine on that damn guard for public sake, otherwise I am making big report to papers...’)।
পেটরোগা বলে বাঙালিকে যতই গাল পাড়ুন, অখিলচন্দ্র সেন নামে সেই বাঙালি যুবকের ভুলে ভরা ভয়ঙ্কর অভিযোগপত্রেই কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ সব শ্রেণির যাত্রীদের জন্য ট্রেনে শৌচাগারের বন্দোবস্ত করেন। সালটা ১৯০৯, ২ জুলাই। অখিলবাবুর সেই চিঠি আজও নয়াদিল্লির রেল মিউজিয়ামে রাখা আছে।
তবে সব সময় কিন্তু ব্যাপারটা নিছক ‘আলুর দম’-এ সীমাবদ্ধ থাকে না। লালগোলা থেকে বহু অসুস্থ ও প্রবীণেরা কলকাতায় আসেন চিকিৎসার জন্য। ট্রেনে শৌচাগার না থাকার কারণে তাঁদের যে কী ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তা তাঁরাই জানেন। কৃষ্ণনগর স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানোর পরে ত্যাগের জন্য রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। নির্দিষ্ট কিছু শৌচাগারে ভিড়ের ঠেলায় ঢুকতে না পেরে নিরুপায় লোকজন লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে যে ভাবে রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন তা দেখে মুখ লুকোবে স্বচ্ছ ভারত মিশনও!
বছর কয়েক আগে ঘাটশিলা থেকে টাটা-খড়্গপুর মেমু ট্রেনে উঠেছিলেন ঘাটশিলার বাসিন্দা হাবুল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ট্রেনে শৌচাগার থাকলেও তা বন্ধ ছিল। খড়্গপুর স্টেশনে ঢোকার আগে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েই সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন থেকে নেমেছিলেন তিনি। হঠাৎ ট্রেন ছেড়ে দেয়। তড়িঘড়ি সেই ট্রেনে উঠতে গিয়ে তিনি দু’টি পা-ই হারান।
অখিলচন্দ্র চিঠি লিখেছিলেন ১৯০৯ সালে। তার পরে কেটে গিয়েছে ১১০ বছর। এখনও লোকালের যাত্রীরা জানেন না, আরও কত দুর্ভোগের পরে শৌচাগার পাওয়া যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy