লাঠি হাতে ইলিয়াস শেখ। নিজস্ব চিত্র
মহরমের দিন সকাল। সোনডাঙ্গার মানিকতলার মাঠপাড়ায় আম, কাঁঠাল গাছে ঘেরা ছোট্ট উঠোনে ‘ঝিনতাক ঝিজোর, ঝিনতাক ঝিজোর’ তালে ঢোল বেজে উঠল।
সব বয়সী মানুষ এসে জড়ো হয় উঠোনে। এক দল যুবক হলুদ রঙের পোশাক পরে তেরাঙা লাঠি হাতে। তাঁরা বিশেষ ছন্দে নাচতে নাচতে উঠোনে প্রবেশ করলেন। ঢোলের সঙ্গে সঙ্গতে কাঁসা, কাঁসি, ঝুমঝুমি।
জানা গেল, এ দিন রাতে স্থানীয় হাইস্কুলের মাঠে জুবলি ক্লাবের উদ্যোগে রয়েছে লাঠি খেলার প্রতিযোগিতা। এ তারই মহড়া।
উঠোনে বসে নাতিদের খেলার জন্য বাঁশের লাঠি তৈরি করেছিলেন পঁচাত্তরের ইলিয়াস শেখ। ঢোলের শব্দ তাঁকেও টেনে আনে। ঢোলের বোলে পা দুলতে থাকে ইলিয়াসের। লাঠিটা খানিক ঘুরিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েন একটা চেয়ারে।
‘‘ঢোল বাজলে যে আর ঘরে থাকা যায় না,’’— বলেন ইলিয়াস।
সামনে তখন লাঠিতে লাঠিতে ঠোকাঠুকির শব্দ। ইলিয়াসের মন স্মৃতি হাতরাচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক বদলে গিয়েছে লাঠি খেলা। তখন খেলোয়াড়দের পোশাক বলতে ছিল সাদা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট। গ্রামে অনেকগুলো দল ছিল। মহরমের সময় বারো, তেরো দিন গ্রামে ঘুরে ঘুরে লাঠি খেলা দেখাত। হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপও চলে যেত।
সে সময়ে কোনও কোনও জায়গায় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত। বাঁশের ডগায় একটা পিতলের ঘরা ঝুলিয়ে দেওয়া হত, কিংবা একটা গোটা খাসি বেঁধে রাখা হত। যে দল জিতবে, পুরস্কার সে দলের।
ইলিয়াসের কাছেই জানা গেল, সে সময় নিষ্ঠার সঙ্গে লাঠি খেলতেন তাঁরা। এই বারো-তেরো দিন চুলে তেল দিতেন না, খেতেন নিরামিষ। কঠোর পরিশ্রম করে এই খেলা শিখতে হত তখন, একটু ভুল-ত্রুটি হলে জুটত ওস্তাদের লাঠির বাড়ি।
গর্ব করে ইলিয়াস জানান, তাঁর ওস্তাদ মহম্মদ ফকির ছিলেন এলাকার দুর্দান্ত ডাকাত। তাঁর কাছে শিখে শুধু লাঠি নয়, লাঙল, ঢেঁকি, মই সবই ঘুরিয়েছেন একটা সময়ে। তখন অনেক ডাকাত দলও লাঠি খেলার প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। খেলাও ছিল অনেক কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ।
আক্ষেপ করে বলেন ইলিয়াস, ‘‘এখন তো ছেলেরা ওস্তাদের কথাই শুনতে চায় না। সবাই লায়েক হয়ে গিয়েছে। এখন সে খেলা কোথায়?’’ জানান তিনি, এখন সিনেমা, নাটকের নকল করে লাঠি খেলা হয়। দেখতে ভাল লাগে কিন্তু ঐতিহ্যই হারাচ্ছে।
আগের মতো লাঠি খেলা যে এখনকার ছেলেরা শিখছে না, তা মানছেন নবীন প্রজন্মের অনেক খেলোয়াড়ই। নবীন প্রজন্মের খেলোয়ার কুতুবুদ্দিন মণ্ডল, আজিবর শেখরা জানালেন, এখন আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে খেলা দেখানোর চল নেই। এখন খেলা মূলত প্রতিযোগিতার জন্য। আর কোনও অনুষ্ঠানে লাঠি খেলা প্রদর্শনের আমন্ত্রণ পেলে। আগের মতো এখন ঢোলের তালে তালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধুই লাঠি খেলাও নেই। যুগের সঙ্গে মানুষের চাহিদা পাল্টেছে। আগের খেলা আর কেউ দেখতে চান না। ইন্টারনেট, মোবাইলের যুগে রংচঙে, আলো ঝলমল খেলা মানুষের বেশি পছন্দ। তাই লাঠির সঙ্গে খেলায় যুদ্ধ দেখাতে হয় নকল কামান, বন্দুক নিয়ে। খেলায় সাজ-পোশাক আর যন্ত্রপাতির ব্যবহারে খেলা দেখানোর খরচ বেড়েছে। মূলত রাজমিস্ত্রি বা চাষের কাজ করা এই সব খেলোয়াড় খরচের ধাক্কা সামলাতে না পেরে অনেকেই বন্ধ করে দিচ্ছেন লাঠি খেলা। জুবলি ক্লাবের এক সদস্য সোলেমান শেখ বলেন, ‘‘গত তিন বছর আগেও গ্রামে লাঠি খেলার সাতটি দল ছিল। এখন তা প্রায় তিনে এসে ঠেকেছে। প্রতিযোগিতাতেও কমছে দলের সংখ্যা।’’
পেশায় মার্বেল মিস্ত্রি ওয়াসিম মণ্ডলের মতো অনেক খেলোয়াড়ই চান, লাঠি খেলার হাল ধরুক সরকার। হারিয়ে যেতে বসা বাংলার লোক সংস্কৃতি বেঁচে উঠুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy