স্তব্ধ অঞ্জনা
এক দিন এই নদী ভয়াবহ বন্যা থেকে রক্ষা করেছিল শহরের হাজার হাজার মানুষকে। কৃষ্ণনাগরিকেরা অনুভব করেছিলেন, অঞ্জনাকে একটু-একটু করে মেরে ফেলে তারা নিজেদের কত বড় ক্ষতি করেছেন। কিন্তু তত দিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।
বেআইনি ভাবে দখল হতে-হতে নদী থেকে খাল, খাল থেকে কার্যত নর্দমায় পরিণত হয়েছে রবি ঠাকুরের কবিতায় ঠাঁই পাওয়া অঞ্জনা। এখন হাজার মাথা চাপড়ালেও অঞ্জনাকে তার পুরনো রূপে ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। তবে হাল ছাড়তে রাজি নয় ‘কিশোর বাহিনী’। অঞ্জনাকে বাঁচানোর জন্য তারা হাঁটল দীর্ঘ পথ। শনিবার রানাঘাটের ব্যাচপুর থেকে যাত্রা শুরু করে নদী লাগোয়া এলাকা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রবিবার তারা পৌঁছল নগেন্দ্রনগরে, যেখানে জলঙ্গি থেকে অঞ্জনার উৎপত্তি।
কৃষ্ণনগর শহরের প্রান্তে শ্মশান কালীবাড়ির কাছে জলঙ্গি নদী থেকে অঞ্জনার উৎপত্তি। তার পর জেলা পরিষদের পিছন হয়ে বেজিখালি হয়ে রাজবাড়ির সামনে দিয়ে শক্তিনগর হাসপাতালের পাশ ঘুরে এই নদী ঢুকে গিয়েছে দোগাছি এলাকায়। তার পর হাটবোয়ালিয়া, খামার শিমুলিয়া, পাটুলি চন্দনদহ হয়ে রানাঘাটের ব্যাসপুরের কাছে চুর্ণী নদীতে মিশেছে। অঞ্জনা বস্তুত জলঙ্গি ও চূর্ণী নদীর ‘ক্রস চ্যানেল’ বা সংযোজিকা, দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে কৃষ্ণনগর শহরের ভিতরে আছে প্রায় ৭ কিলোমিটার।
গোটা অঞ্জনাই নানা ভাবে দখল হয়ে আছে। কোথাও নদীখাত দখল করে তৈরি হয়েছে বাড়িঘর-দোকান, কোথাও আনাজ চাষ হচ্ছে তো কোথাও মাছ চাষ। নদী তার স্বাভাবিক বহমানতা হারিয়েছে অনেক দিন আগেই। জলঙ্গি গতিপথ পরিবর্তন করেছে বারবার। জলঙ্গিতে জোয়ারের জল ঢোকাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চার উপরে রাজা রুদ্র রায়ের আমলে বাহিরাগতদের শহরে প্রবেশের উপরে নিয়ন্ত্রণ আনতে নদীর উৎসমুখ ছোট করে দেওয়াও অঞ্জনার বেহাল দশার জন্য দায়ী বলে অনেকের ধারণা।
বছরের পর বছর ধরে শহরের বুকে নদীর দুই পাড় দখল করে বেআইনি নির্মাণ হয়েছে। নদী ক্রমশ খাল থেকে নালায় পরিনত হয়েছে। আর ততই ভেঙে পড়েছে কৃষ্ণনগর শহরের নিকাশি। বেশির ভাগটাই সরু খালের আকার নিয়েছে। এখন তাকে দেখে কোনও ভাবেই বোঝার উপায় নেই কোন সজীব বহমান নদীর রূপে মুগ্ধ হয়ে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন ‘অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে...’।
অথচ নিকাশির ক্ষেত্রে এই নদীর খাত যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল ২০০০ সালের বন্যার সময়েই। সে বার এই নদীর শীর্ণ খাত ধরেই সরে গিয়েছিল শহরের জল। তার পর থেকে অঞ্জনা সংস্কারের জন্য নানা চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তার সবটাই হয়েছে ক্ষণস্থায়ী ও অপরিকল্পিত ভাবে। অঞ্জনার খাত দখলমুক্ত করতে গিয়ে মামলায় জড়িয়ে যেতে হয়েছে পুরসভাকে। কিন্তু তার পরও শহরের সৌন্দর্য ও নিকাশির জন্য নদীখাত সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন শহরের মানুষ।
গত বছরই জেলা সফরে এসে অঞ্জনা সংস্কারের প্রকল্প তৈরি করে পাঠাতে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি সংস্থাকে দিয়ে সমীক্ষা করায় কৃষ্ণনগর পুরসভা। তার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে সামগ্রিক ভাবে একটি প্রকল্প তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়। সেই মতো ‘গ্রিন সিটি’ প্রকল্পের ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা অনুমোদন করা হয়েছে বলে পুরসভা সূত্রের খবর। শহরের মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী অঞ্জনা নদীর খাত সর্বনিম্ন ২৪ ফুট চওড়া, কোথাও কোথাও তা আবার দেড়শো ফুটেরও বেশি। সমীক্ষা করে প্রকল্প বানিয়ে নদীকে কি আদৌ তার আদিরূপ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব, নাকি কিছু বাহ্যিক সৌন্দর্যায়নে যাবতীয় প্রচেষ্টার ইতি ঘটবে, সেই প্রশ্নটা কিন্তু উঠতে শুরু করেছে।
নদিয়া জেলার সেচ দফতরের এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সুরজিৎ ধরের মতে, “কৃষ্ণনগর শহরের বাইরে অঞ্জনা নদীর সংস্কারের তেমন কোনও প্রয়োজন নেই। তবে শহরের ভিতরে অবস্থা খুবই করুণ। নদীখাত দখল করে নানা ধরণের নির্মাণ হয়েছে। নদী হয়েছে নালা। ফলে এখানে সংস্কার করাও কঠিন। আমাদের তেমন কোনও পরিকল্পনাও নেই।”
বড় কথা হল, এ বার নাগরিক সমাজের ভিতর থেকে অঞ্জনা সংস্কার করার দাবিটা উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু অঞ্জনাকে বাঁচাতে গেলে শুধু নাগরিক বা প্রশাসনিক উদ্যোগ নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছাও জরুরি। ভোট আসে ভোট যায়। বিভিন্ন দল অঞ্জনা নিয়ে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেয়। কিন্তু ভোট মিটে গেলে সেই প্রতিশ্রুতি মজা খাত দিয়ে বয়ে গিয়েছে এত দিন।
এ বার কি কোনও বদল ঘটবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy