প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি ‘পরীক্ষা-পে চর্চা ২০২৫’ এবং বহুল প্রচারিত ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে স্থূলতা বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্থূলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ছোটদের, বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়াদের। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে সে প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরই নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক। সচিব সঞ্জয় কুমার দেশের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের শিক্ষা সচিব এবং মিড-ডে মিল দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন মিড-ডে মিলের রান্নায় তেলের ব্যবহার দশ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে হবে। এই নির্দেশকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে শিক্ষামহলে।
নামমাত্র বরাদ্দে যেভাবে মিড-ডে মিল রান্না হয় স্কুলগুলিতে তার পরেও যদি তেলের পরিমাণ আরও কমিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেই রান্না কি আদৌ মুখে তুলতে পারবে পড়ুয়ারা, প্রশ্ন তুলছেন বিদ্যালয় প্রধানেরা। শুধু তাই নয়, বিস্বাদ কম তেলে রান্না করা স্বাদহীন খাবারের কারণে মিড-ডে মিলের প্রতি আকর্ষণ হারাতে পারে পড়ুয়ারা। বন্ধ করে দিতে পারে স্কুলের রান্না খাওয়া। তাতে করে স্কুলে উপস্থিতির হারও কমতে পারে। দীর্ঘ দু’বছরেরও বেশি সময় সামান্য বেড়ে এখন মিড-ডে মিল প্রকল্পে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেনির জন্য বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ১৯ পয়সা এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বরাদ্দ ৯ টাকা ২৯ পয়সা। ওই টাকাতেই খাদ্যতালিকা হিসেবে ডাল, ডিম, সয়াবিন, আনাজ সহযোগে পড়ুয়াদের খাওয়াতে হয়।
শিক্ষকদের কথায়, এত কম টাকায় এমনিতেই পর্যাপ্ত তেলের ব্যবহার সম্ভব হয় না। তার পরেও যদি আরও ১০ শতাংশ তেলের ব্যবহার কমাতে হয় তাহলে সে খাবার আদৌ পড়ুয়াদের মুখে রুচবে কিনা তা নিয়েই সংশয় আছে।
ধুবুলিয়া নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা চন্দনা ভট্টাচার্য বলেন, “কম তেলে রান্না নিশ্চয় স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। কিন্তু যে পরিমাণ তেলে এখন মিড-ডে মিল রান্না হয় এর থেকে কম তেলে দিয়ে রান্না করা অসম্ভব। কার্যত সেটা হয়ে দাঁড়াবে বিনা তেলে রান্না করা। তাহলে এ বারে ছেলেমেয়েদের সেদ্ধ খাওয়াতে হবে।”
শিক্ষকদের বড় অংশই মনে করেন এর ফলে সুষম, পুষ্টিকর খাদ্য পড়ুয়াদের মুখে তুলে দেওয়ার যে উদ্দেশ্য নিয়ে মিড-ডে মিল চালু হয়েছিল তা ব্যাহত হবে।
শিক্ষকদের একাংশের প্রশ্ন, যে কোনও বিষয়ে সবার প্রথমে মিড-ডে মিলকে কেন মনে পড়ে? তেলের ব্যবহার কম করতে বলে কৌশলে বরাদ্দ বৃদ্ধির দায় এড়ানোর চেষ্টা নয় তো? দেপাড়া-বিষ্ণুপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অজিত ভট্টাচার্য বলেন, “এ কথা ঠিক, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনচর্চার পরিবর্তন বর্তমান সময়ের দাবি। কিন্তু স্থূলতা কি শুধু তেলই কি বাড়াচ্ছে? তাও আবার মিড-ডে মিলে? শিক্ষার অন্য বিষয়গুলোর দিকে নজর কই?”
এবিটিএয়ের নদিয়া জেলা সম্পাদক সৌমেন পালের বক্তব্য, কম তেলে রান্না নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু সেই অভ্যাস পড়ুয়াদের বাড়িতে তৈরি করা দরকার। তিনি বলেন, “ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই এখন তেলমশলা দেওয়া খাবার বেশি পছন্দ করে। কাজেই অভিভাবকদের সচেতন করা আগে দরকার। সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? বাড়িতে হবে একরকম রান্না আর স্কুলে অন্য রকম। এতে মিড-ডে মিলে আগ্রহ হারাতে পারে পড়ুয়ারা।”
তৃণমূল শিক্ষক সংগঠনের নদিয়া উত্তরের সভাপতি দিলীপ সিংহ বলেন, “ছোটরা সুষম খাদ্যের সঙ্গে সুস্বাদু খাবার চায়। এখন যদি ১০ শতাংশ তেল কম দিয়ে রান্না করতে হয় ছেলেমেয়েরা খাবে না। গ্রামাঞ্চলে এর অন্যরকম প্রভাব পড়তে পারে। এই সিদ্ধান্ত ঠিক নয়।”
যদিও বিজেপি শিক্ষক সংগঠনের নদিয়া জেলা আহ্বায়ক অমিত চট্টোপাধ্যায় পাল্টা বলেন, “বাঙালিরা তেলমশলা ছাড়া খেতে পারে না। তাই এত কথা উঠছে। এটা একটা সর্ব ভারতীয় নির্দেশিকা। দেশের অন্য রাজ্যের খাদ্যাভ্যাস দেখুন, কম তেলে কেউ আপত্তি করেনি। বিরোধিতা কেবল বাংলায়।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)