Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

ইলিশ বিনে বিস্বাদ ভোজবাড়ির পাতও

দিব্য জেনে-শুনে ইলিশ নামক ‘বিষপান’ করে বেহস্ত লাভে বাঙালির জুড়ি নেই। অথচ সেই ইলিশগত প্রাণ বাঙালির পাতেই এ বার ইলিশ নাস্তি!

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৯ ০০:১৮
Share: Save:

মহম্মদ-বিন তুঘলকের মৃত্যুর জন্য নাকি দায়ী ছিল ইলিশ মাছ! সৈয়দ মুজতবা আলী তেমনটাই লিখেছেন।

এক বার জলপথে যাওয়ার সময়ে তাঁর বজরায় লাফিয়ে পড়েছিল জলের রাজপুত্র। সকালের রোদে ঝিকমকিয়ে ওঠা সেই রুপোলি মাছকে অবশ্য সম্রাট বা তাঁর সঙ্গীসাথিরা কেউই চিনতেন না।

তাতে কি! ‘পাগলা রাজার’ হুকুমে সে মাছ রান্না হল তৎক্ষণাৎ। কথিত আছে, স্বাদ ভাল লাগায় পাত্রমিত্রদের পরামর্শে কান না দিয়ে সম্রাট সেই অচেনা মাছ অনেকটাই খেয়ে ফেলেন। এর পরে তাঁর পেটের গোলমাল দেখা দেয়। এবং সেই কারণেই কি না জানা নেই, কয়েক দিনের মধ্যেই সম্রাটের মৃত্যু হয়। মুজতবা আলী তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বলা এই কাহিনি শেষ করেছেন একটি সরস মন্তব্য দিয়ে, “সেই অচেনা মাছটি ইলিশই ছিল। এবং ইলিশ খেয়ে যখন সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে তখন নিশ্চিত তিনি বেহস্তে গেছেন।”

দিব্য জেনে-শুনে ইলিশ নামক ‘বিষপান’ করে বেহস্ত লাভে বাঙালির জুড়ি নেই। অথচ সেই ইলিশগত প্রাণ বাঙালির পাতেই এ বার ইলিশ নাস্তি! ভরা শ্রাবণে এ পার-ও পার কোনও ইলিশেরই এখনও পর্যন্ত দেখা নেই। এমন ইলিশহীন বর্ষা শেষ কবে দেখেছেন মনে করতে পারছেন না অতি বড় ইলিশ ভক্তও।

মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘বর্ষাই নেই তো ইলিশ আসবে কোথা থেকে’! রোদহীন মেঘলা আকাশ। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। ঠান্ডা পুবালি বাতাসের সঙ্গে কাঁপন ধরনো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ইলিশের আদর্শ মরসুম। যদিও সেই আবহাওয়ার সন্ধান মেলে কেবল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের পাতায়। তবে উপন্যাসের কুবের বা যদুর সঙ্গে বাস্তবের তপন হালদার বা কার্তিক মণ্ডলদের আক্ষেপটা আশ্চর্য রকম এক— হা ইলিশ! কোথা ইলিশ!

যা অবস্থা, গেরস্তের রান্নাঘর থেকে ভোজবাড়ির রসুইখানা, কোথাও সে নেই। মেয়ের বিয়েতে কিংবা ছেলের বৌভাতে নিমন্ত্রিতদের ইলিশ ভাপা বা কলাপাতায় মোড়া ইলিশ পাতুরি খাওয়ানোর ইচ্ছা অনেকেরই। বিশেষ করে তিনি যদি পূর্ববঙ্গের মানুষ হন, তা হলে তো কথাই নেই। শুধু সেই কারণেই আষাঢ়ে-শ্রাবণে অনেকে বিয়ের দিনস্থির করেন। কিন্তু এ বার পরিস্থিতি এতই সঙ্গীন যে বিয়েবাড়ির পূর্ব নির্ধারিত পদ থেকে ইলিশের পদ বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন কেটারিং মালিক। পমফ্রেট, ভেটকিতে পাত কৌলীন্য হারাবে জেনেও নিমন্ত্রণ কর্তা বাধ্য হয়ে মেনে নিচ্ছেন। কোথাও আবার আগের চুক্তির চেয়ে প্লেট পিছু বেশি টাকা গুনে দিতে হচ্ছে। কোনও কোনও কেটারিং মালিক আবার অগস্ট পর্যন্ত ইলিশের বরাত নেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন।

কেটারিং ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, স্থানীয় বাজারে ভোজবাড়ির উপযোগী ইলিশ নেই। কলকাতার পাইকারি বাজারে কেজিখানেকের মাছ ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। শনিবার মাঝরাতের ট্রেনে কলকাতার বাজারে ইলিশের খোঁজে ছুটেছিলেন নবদ্বীপের এক কেটারিং ব্যবসায়ী শান্তনু ভৌমিক। তিনি বলছেন, “ওখানে পাইকারি বাজারের অবস্থাও খুব খারাপ। গত বছর অগস্ট-সেপ্টেম্বরে ধরা স্টোরের ইলিশ ছাড়া কিছু নেই। তারও দাম বারোশো টাকার আশপাশে। তবে সেই ইলিশ খেয়ে বা খাইয়ে কেউ খুশি হবে না। আমাদের সুনাম নষ্ট হবে। তাই অগস্টের আগে আর ইলিশের কাজ ধরছি না।”

আর এক ব্যবসায়ী নিতাই বসাক বলছেন, “আষাঢ়-শ্রাবণে ভোজবাড়ির কাজে লোকে ইলিশটাই খাওয়াতে চায়। কিন্তু এ বার বাজারে মাছ নেই বলে তিন বা চার মাস আগে করা চুক্তি অনুযায়ী মেনু করতে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। হয় পদ বদলাতে হচ্ছে না-হয় প্লেট পিছু দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকছে না।”

নিতাই জানান, শুক্রবার রাতে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের ছেলের বৌভাতের কাজ ছিল। তিন মাস আগে ইলিশ সমেত চুক্তি হয়েছিল চারশো টাকা প্লেট। “কিন্ত এখন যা অবস্থা তাতে ওঁর সঙ্গে কথা বলে প্লেট পিছু কুড়ি টাকা করে বাড়িয়ে ইলিশের কাজ করতে হল”— বলেন নিতাই। যাঁরা এই অতিরিক্ত খরচ বহন করতে পারবেন না, তাঁদের ভরসা পাবদা চিতল ভেটকি। তাতে কি মন ভরে!

...ইলিশ কবে আসবে, সুপর্ণা?

অন্য বিষয়গুলি:

Hilsa Monsoon Bengalis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy