তাপস পাল
নায়ক আসবেন জেনে সে দিন সকাল থেকেই চ্যালেঞ্জের মোড়ে ভিড় উপচে পড়েছিল। শুধু তৃণমূল কর্মীরা নন, শহরের সাধারণ মানুষও অগণন। ‘দাদার কীর্তি’, ‘সাহেব’, ‘গুরুদক্ষিণা’র আটপৌরে নায়ককে এক বার কাছ থেকে দেখতে, পারলে ছুঁয়ে নিতে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল।
২০০৯ সালে নদিয়ায় এমন এক তারকা প্রার্থী পেয়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা একযোগে ঝাঁপিয়েছিলেন। কৃষ্ণনগর থেকে চাপড়া, নাকাশিপাড়া থেকে কালীগঞ্জ, যেখানেই তাপস যাচ্ছেন সেখানেই উপচে পড়ছে মানুষ। বিরোধীরা বলেছিল, এই ভিড় আসলে সিনেমার নায়ককে দেখার ভিড়। ভোটের বাক্সে তার প্রভাব পড়বে না। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণ করে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী, বিজেপির সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় ও সিপিএমের জ্যোতির্ময়ী শিকদারকে (বর্তমানে তৃণমূলে) বিপুল ভোটে হারিয়ে সাংসদ হলেন তাপস পাল।
প্রথম দিন এসেই তাপস কথা দিয়েছিলেন, তাঁকে নির্বাচনে জেতালে তিনি কৃষ্ণনগরেরই এক জন হয়ে উঠবেন। সেই কথা তিনি রেখেছিলেন। তারকার খোলস ছেড়ে ফেলে হয়ে উঠেছিলেন একেবারে কাছের মানুষ। কৃষ্ণনগরে এলে সকলের জন্য থাকত তাঁর অবারিত দ্বার। থাকতেন ক্ষৌণীশ পার্কের কাছে সুভাষচন্দ্র বসুর বাড়িতে। দলের কর্মীরা তো বটেই, সেই বাড়িতে সহজেই ঢুকে পড়তে পারতেন যে কেউ।
কিন্তু সেই সব আনাগোনাই যেন এক সময়ে তাপসের জীবনে কাল হয়ে উঠল। তাঁর আশপাশে ভিড় জমাতে শুরু করলেন দলেরই কিছু স্বার্থান্বেষী নেতাকর্মী। অনেকের মতে, এই দুষ্টচক্র তাঁকে এক সময়ে বিপথে চালিত করতে শুরু করে। সাংসদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। যদিও নিজের এলাকায় সাংসদ কোটার টাকা খরচ করে উন্নয়নের কাজে তিনি এগিয়ে ছিলেন অনেকের থেকেই। কিন্তু বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দল ও দলের বাইরে ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলছিলেন। এই সময়ে জেলা নেতৃত্বের একটা অংশের সঙ্গে তাঁর দূরত্বও তৈরি হতে থাকে।
এ ভাবেই কেটে যায় প্রথম পাঁচটা বছর। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে দলেরই জেলা নেতাদের একটা অংশ তাপসকে প্রার্থী হিসাবে চাইছিলেন না। অনেকেই মনে করছিলেন, নেত্রী বুঝি তাঁকে আর প্রার্থী করবেন না। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের কর্মীদের নিয়ে ভাতজাংলায় সভা করলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে উপস্থিত তাপস পালের সঙ্গে একটাও কথা বললেন না তিনি। আর তা থেকে অনেকেই ধারণা করলেন, এ বার আর তাপসের প্রার্থী হওয়া হচ্ছে না। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে তাপসই আবার টিকিট পেলেন।
কিন্তু এ বার দলেরই নেতাকর্মীদের মনে তাপসের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়। তত দিনে দলের অনেকের সঙ্গেই তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাঁকে ঘিরে ফেলেছে এক দল সুযোগসন্ধানী। দলের অনেককেই আর সর্বশক্তি দিয়ে ভোটের ময়দনে নামতে দেখা গেল না। প্রচারে আগের মতো আর ভিড়ও নেই। নেই মানুষের হুড়োহুড়ি। কিন্তু সব আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে ফের জয়ী হলেন তাপস।
এর মধ্যে তাপসের নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কথাবার্তাও কখনও কিছুটা অসংলগ্ন। ঘনিষ্ঠেরা দাবি করেন, স্নায়ুর সমস্যার কারণে তাঁকে কড়া-কড়া ওষুধ খেতে হত। র এরই মধ্যে ঘটে গেল ‘চৌমুহা কাণ্ড’। নির্বাচনের দিন সেই গ্রামে সিপিএমের সঙ্গে অশান্তি হয়েছিল তৃণমূলের। কিছু দিন পরে তাপস সদলবলে সেখানে গিয়ে হুমকি দিলেন, ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব’। তখনকার মতো কিছু না হলেও মাস ঘুরতে না-ঘুরতেই মোবাইলে তোলা সেই কথার ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল।
শুরু হল নিন্দার ঝড়। শুধু বিরোধীরা নয়, দলের নেতাকর্মীরাও প্রকাশ্যে তাপসের নিন্দা করতে লাগলেন। সে দিন তাঁর ঘনিষ্ঠ যাঁরা চৌমুহা গ্রামে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরাও বেগতিক বুঝে তাঁর পাশ থেকে সরে গেলেন। নদিয়ায় কার্যত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন তাপস। কৃষ্ণনগরে আসাও বন্ধ করে দিলেন। এর অনেক দিন পর আবার তিনি আস্তে আস্তে কৃষ্ণনগরে আসা-যাওয়া শুরু করলেও হাতে গোনা কয়েক জন ছাড়া কাউকে তাঁর আশপাশে দেখা যেত না। নিঃসঙ্গ তাপস এসে উঠতেন সার্কিট হাউজ়ে। চৌমুহায় বলা ওই কথার জন্য তিনি সাংবাদমাধ্যমের সামনে একাধিক বার ক্ষমাও চেয়ে নেন।
তত দিনে কিন্তু তাপসের কথাবার্তা আরও অসংলগ্ন হয়ে গিয়েছে। তবুও আগের বহু কিছু ভুলে কৃষ্ণনগর তাঁকে ফের গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। সংবাদমাধ্যমের কাছেও তিনি আগের চেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছিলেন। ঠিক এমন একটা সময়ে খবর এল যে রোজ় ভ্যালি কাণ্ডে তাঁকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। সেই যে তাপসের সঙ্গে কৃষ্ণনগরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, আর জোড়া লাগেনি। চৌমুহা আর ‘দাদার কীর্তি’ মিলেমিশে একাকার হয়ে রইল নদিয়ার মানুষের মনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy