যক্ষ্মা দূরীকরণে জোর দেওয়া হয়েছে। তবে দূরীকরণের নাম নেই! পশ্চিম মেদিনীপুরে গত তিন মাসে নতুন করে প্রায় দেড় হাজার যক্ষ্মা রোগীর হদিশ মিলেছে। আজ, সোমবার বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। এই জেলাতেও দিনটি পালিত হবে। তবে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যায় রাশ আসবে কবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গী বলেন, ‘‘যক্ষ্মা দূরীকরণের সব রকম চেষ্টা চলছে।’’ তিনি মনে করাচ্ছেন, দূরীকরণের লক্ষ্যেই যক্ষ্মা রোগী চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া চলে।’’
নতুন যক্ষ্মা রোগী চিহ্নিতকরণে একশো দিনের বিশেষ অভিযান হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৭ মার্চ পর্যন্ত এই অভিযান চলেছে। লক্ষ্য ছিল দ্রুত রোগী শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদান। জেলা স্বাস্থ্যভবন সূত্রে খবর, প্রায় ৭ লক্ষ ২৫ হাজার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ জনসংখ্যায় কাজ চলেছে। এঁদের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার জনের পরীক্ষা করা হয়েছিল। দেখা গিয়েছে, ওই ৪০ হাজার জনের মধ্যে প্রায় ১,৫০০ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত। জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তা মানছেন, ‘‘একশো দিনের বিশেষ অভিযানে প্রায় দেড় হাজার রোগী চিহ্নিত হয়েছে। তাঁদের চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে।’’ পশ্চিম মেদিনীপুরে ২১১টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। ওই সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত যক্ষ্মামুক্ত হয়েছে। শতাংশের নিরিখে যা ১৭ শতাংশ।
প্রতি বছর নতুন রোগী চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোয় জেলা স্বাস্থ্যভবন। পশ্চিম মেদিনীপুরে বছরে নতুন করে গড়ে ৫ হাজারের বেশি যক্ষ্মা রোগীর খোঁজ মেলে। মাসে গড়ে ৪২০-৪৩০ জন নতুন রোগীর হদিস মেলে। সাধারণ যক্ষ্মা ৬-৯ মাসের চিকিৎসায় সেরে গেলেও প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর) সারতে সময় লাগে ন্যূনতম ২৪-২৭ মাস। দেখা গিয়েছে, নতুন যক্ষ্মা রোগীদের ২-৩ শতাংশ এমডিআর যক্ষ্মায় সংক্রমিত হন। আর যত যক্ষ্মা রোগী দ্বিতীয়বার যক্ষ্মায় সংক্রমিত হন, তাঁদের মধ্যে ১৫ শতাংশের দেহে এমডিআর যক্ষ্মা পাওয়া যায়। জেলার এক স্বাস্থ্য আধিকারিক মনে করাচ্ছেন, বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ মানুষের শরীরে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু সুপ্ত থাকে। একজন যক্ষ্মা রোগী অন্তত ১০-১৫ জনকে সংক্রমিত করতে পারেন।
যক্ষ্মা সাধারণত প্রাপ্ত বয়স্কদেরই হয়। জেলার ওই স্বাস্থ্য আধিকারিক মানছেন, ওষুধ খাওয়ার অনিয়মেই শক্তিশালী হয় নতুন ধরনের যক্ষ্মার জীবাণু। যক্ষ্মার আধুনিক এবং নিশ্চিত পরীক্ষা সিবিন্যাট (কার্টিজ বেসড নিউক্লিক অ্যাসিড অ্যাম্পিফিকেশন টেস্ট)। জেলার মধ্যে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতাল, ঘাটাল মহকুমা হাসপাতাল এবং বেলদা গ্রামীণ হাসপাতালে সিবিন্যাট পরীক্ষার যন্ত্র রয়েছে। এই জেলার এক চিকিৎসক মানছেন, ‘‘সিবিন্যাট পরীক্ষার যন্ত্রে কম সময়ে যক্ষ্মার সঠিক নির্ণয় সম্ভব হয়।’’ তিনি জুড়ছেন, ‘‘মূলত, কনফার্মেটরি টেস্ট করতেই সিবিন্যাট পরীক্ষা করা হয়। নিউক্লিক অ্যাসিড টেস্ট বা ন্যাটের সাহায্যে জিন পরীক্ষা করে দেখা হয়, যক্ষ্মার জীবাণুটি সাধারণ না ওষুধ-প্রতিরোধী।’’
যক্ষ্মা রোগের জন্য দায়ী মাইকো ব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস। এই জীবাণু সাধারণত ফুসফুসে আক্রমণ করে। ছড়ায় বাতাসের মাধ্যমে। এক আক্রান্ত থেকে আরেক আক্রান্তের শরীরে। যক্ষ্মায় প্রতি বছর গড় মৃত্যুর হার ৫ শতাংশ। যক্ষ্মা রোগীদের আরও একাধিক রোগে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশি— এগুলিই যক্ষ্মার উপসর্গ। এখন প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর টিবি অর্থাৎ মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি) নির্ণয় করা যাচ্ছে মেদিনীপুর মেডিক্যালেই। চালু হয়েছে ‘সি অ্যান্ড ডিএসটি’ (কালচার অ্যান্ড ড্রাগ সাসসেপ্টিবিলিটি টেস্টিং) ল্যাবরেটরি।
যক্ষ্মা দূরীকরণে এই রাজ্যের কয়েকটি জেলায় প্রাপ্তবয়স্কদের ফের বিসিজি টিকা (যক্ষ্মা রোধে) দেওয়া হচ্ছে। ‘পাইলট প্রোজেক্ট’ হিসাবে এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
তবে ওই জেলাগুলির মধ্যে অবশ্য পশ্চিম মেদিনীপুর নেই।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)