Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Malbazar Flash Flood

মাল নদীতে প্রাণ বাঁচিয়ে জীবনের নায়ক, কে এই সাত রাজার ধন এক ‘মানিক’?

প্রতি বছরই বিসর্জন দেখতে মাল নদীতে যান মহম্মদ মানিক। উৎসব সমারোহ দেখতে ভাল লাগে তাঁর। এ বছর দশমীর রাতেও পরিবারের সকলকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি।

জলপাইগুড়ির নায়ক মহম্মদ মানিক।

জলপাইগুড়ির নায়ক মহম্মদ মানিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২২ ২০:১৪
Share: Save:

দূরে দাঁড়িয়ে একমনে ঢাকের বাদ্যি শুনতে শুনতে ঘোর লেগে গিয়েছিল তাঁর মনে। বিদায়ের বাজনায় মন খারাপ। আচমকা সেই ঘোর ভাঙে চিৎকার আর আর্তনাদে। সম্বিত ফিরতেই দেখেন, লহমায় তীব্র জলস্রোত তছনছ করে দিয়েছে নদীর চরের উপর তৈরি বিসর্জনের ঘাট। পাক খেতে খেতে নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে বাচ্চা থেকে বয়স্করা। ভয়াবহ সেই দৃশ্য এখনও ভুলতে পারছেন না জলপাইগুড়ির পশ্চিম তেশিমিলা গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ মানিক। নিমেষে এত মানুষকে ভেসে যেতে দেখে বসে থাকতে পারেননি। পরিবারের প্রতি পিছুটান, দায়িত্ব সব ভুলে ১৫ ফুট উঁচু পাড় থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। চোখের সামনে যত জনকে ডুবতে-ভাসতে দেখেছেন, বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। পেরেছেনও। জনা দশেক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে মানিক এখন জলপাইগুড়ির চোখের মণি হয়ে উঠেছেন।

মালবাজার ব্লকের পশ্চিম তেশিমিলা গ্রামে মানিকের বাড়ি। পেশায় গ্রিল ওয়েল্ডিংয়ের কারিগর। বাড়িতে রয়েছেন বাবা, মা, ছোট ভাই ও বোন। রয়েছেন স্ত্রী। এক শিশু সন্তানও রয়েছে ওঁদের। সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত এই পরিবারের পেট চালানোর দায়িত্ব মানিকেরই কাঁধে। কিন্তু বিসর্জনের দিন চোখের সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখে সে সব মনেও ছিল না মানিকের। গ্রামের ছেলে রাব্বু প্রধানের হাতে নিজের মোবাইল ফোনটা দিয়েই নদীতে ঝাঁপ দেন। তাঁর কথায়, ‘‘সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। ভুলতেই পারছি না। কত কত মানুষ ভেসে যাচ্ছিল চোখের সামনে! চারিদিকে শুধু চিৎকার আর আর্তনাদ। এ সব দেখে আর কিছুই ভাবিনি আমি। জীবনের ঝুঁকি হয়তো ছিল। কিন্ত ও সব মাথাতেও আসেনি।’’

রাব্বু বলেন, ‘‘আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মোবাইল আর ঘড়ি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল মানিক। আমি সাঁতার জানি না। তাই, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম, একের পর এক মানুষের হাত ধরে টেনে তাঁদের পাড়ে তুলছে মানিক। এখন ও আমাদের গ্রামের হিরো।’’

প্রতি বছরই বিসর্জন দেখতে মাল নদীতে যান মানিক। উৎসব সমারোহ দেখতে ভাল লাগে তাঁর। বুধবার দশমীর রাতেও সপরিবারে সেখানে গিয়েছিলেন। সেই চেনা বিষাদমাখা আনন্দের ছবি যে কী ভাবে আতঙ্কের ছবিতে বদলে গেল, তা ভেবে পাচ্ছেন না মানিক। তাঁর কথায়, ‘‘ওই বানে অনেক শিশু ভেসে যাচ্ছিল। সে দিকে তাকিয়ে আমার বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তাই আর কিছু না ভেবে জলে ঝাঁপ দিয়েছি।’’

মহানন্দার তিরে মানিকের বেড়ে ওঠা। ছোটবেলায় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নদীতে স্নান করতে যেতেন। হঠাৎ করে নদীর এই ভাবে ফুঁসে ওঠা তাঁর পরিচিত। ‘পাগলা’ বানে নদী কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা মানিকের ভাল মতোই জানা। তিনি বলেন, ‘‘আমি ভাল সাঁতার জানি। তাই, মৃত্যুভয় সে রকম ছিল না। তখন আমার মাথায় একটাই জিনিস ঘুরছিল। মানুষগুলোকে বাঁচাতে হবে। আমার মতো ভাল সাঁতারু আরও কয়েকজন থাকলে হয়তো কেউই মরতেন না।’’

উঁচু পা়ড় থেকে জলে ঝাঁপ দিতে গিয়ে পায়ে চোটও পান মানিক। গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে। পাশে দাঁড়ানো একজনের থেকে রুমাল নিয়ে ক্ষত বেঁধে আবার কাজে লেগে পড়েন। পরে রাতের দিকে উদ্ধারকাজ থামলে তাঁকে মালবাজার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করানো হয়। মানিক বলেন, ‘‘কত জনকে শেষ পর্যন্ত পাড়ে তুলতে পেরেছি, মনে নেই। আফসোস একটাই, সবাইকে বাঁচাতে পারলাম না। মালবাজার পুরসভার লোকজন ও পুলিশ যথাসাধ্য করেছেন। তবে হঠাৎ এই তীব্র জলস্রোতের কাছে মানুষ তো অসহায়। মনে শান্তি পারছি না। শুধু মনে হচ্ছে, কেন আর কয়েক জনকে বাঁচাতে পারলাম না? সবাইকে বাঁচাতে না পারাটাই আমার হার।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Malbazar Flash Flood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE