সংরক্ষিত: ওয়াল্টার ডিকেন্সের সমাধিফলক। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে পাড়ি দিয়েছিল ছেলেটি। সাউদ্যাম্পটন বন্দর থেকে জাহাজে ওঠার সময়ে বিদায় জানাতে এসেছিলেন বাবা এবং দাদা। প্রথম ক’টা দিন মুষড়ে পড়লেও, পেশাগত দিক থেকে ছেলের হিল্লে হয়ে গেল ভেবে বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠেন বাবা। তিনি পরে একটি চিঠিতে লেখেন, এ ভাবে ছেলেকে বিদায় জানানো খুবই দুঃখজনক। তবে যতটা আশা করেছিলেন, ছেলে তার থেকেও বেশি পরিণত ভাবে বিষয়টি সামলেছে। ১৮৫৭ সালে ছেলে পৌঁছয় কলকাতায়। সেনাবাহিনীতে পদোন্নতিও হয়। বছর ছয়েক পরে দেশে ফেরার তোড়জোড় চলছে যখন, তখন এ শহরেই মৃত্যু হয় ছেলেটির। দিনটা ১৮৬৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। প্রায় দেড় মাস পরে, ১৮৬৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সুদূর ইংল্যান্ডে যখন ছেলেটির মৃত্যুর খবর পৌঁছয়, সে দিন আবার ঘটনাচক্রে বাবার জন্মদিন।
যেন কোনও উপন্যাসের ভাগ্যহত কিশোর বা তরুণ চরিত্রের জীবনকাহিনি। ঠিক যেমনটা লেখার জন্য বিখ্যাত ছেলেটির বাবা, ইংরেজ সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স। আর যে তরুণ কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তাঁর নাম ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডর ডিকেন্স। চার্লস এবং তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিনের চতুর্থ সন্তান।
বিখ্যাত পিতার মতো ছেলেরও নাকি লেখার দিকে ঝোঁক ছিল। তবে ডিকেন্স ছেলের শিক্ষককে নির্দেশ দেন, ছেলের মাথা থেকে লেখালেখির ভাবনা তাড়াতে। লেখাকে পেশা হিসেবে না নিলেই ছেলের উন্নতি হবে, ছেলে আনন্দে থাকবে বলে বিশ্বাস ছিল ডিকেন্সের। বাবার পরিচিতদের সুপারিশে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ওয়াল্টার। কয়েক বছর কাজ করার পরে পদোন্নতি হয়ে লেফটেন্যান্ট হন তিনি। তবে দেনার জেরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে তাঁর। ১৮৬৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর কলকাতার অফিসার্স হাসপাতালে মৃত্যু হয় ওয়াল্টারের। দেহ কবর দেওয়া হয় ভবানীপুরের মিলিটারি সমাধিক্ষেত্রে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯১১ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ভবানীপুর সমাধিক্ষেত্রের প্রবেশপথের কাছে ওয়াল্টারের সমাধিটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। ঘাসে ঢাকা পড়ে ছিল সেটি।
ওয়াল্টার ডিকেন্সের সমাধিফলক স্থানান্তরের বিষয়টি জানিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের তরফে লাগানো আর একটি ফলক। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
বহু বছর পরে, ১৯৮৭ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের উদ্যোগে শুধু সমাধিফলকটি স্থানান্তরিত করা হয় পার্ক স্ট্রিট সমাধিক্ষেত্রে। পাথরের সাধারণ একটি ফলক। আড়াআড়ি ফাটা। উপরের লেখাও পড়া দুষ্কর। আর-পাঁচটা স্মৃতিসৌধের মতো স্থাপত্যগত দিক দিয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয় কোনও ভাবেই। কলকাতার হেরিটেজ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থার কর্ণধার তথাগত নিয়োগী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ডিকেন্স বিখ্যাত লেখক। তাঁর ছেলে এ দেশে এসেছিলেন একটি ঐতিহাসিক সময়ে। সেই দিক থেকে ফলকটির গুরুত্ব তো রয়েইছে। তা ছাড়াও সরকারি উদ্যোগের বাইরে একটি শহরের হেরিটেজ রক্ষায় যে হাতে গোনা কয়েক জনের চেষ্টাও ফলপ্রসূ হতে পারে, তার ভাল উদাহরণ এটি।’’ তবে আসল সমাধিটি এখন আর খুঁজে পাওয়া যান না।
শিশু ওয়াল্টারের ‘ব্যাপটিজ়ম’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইংল্যান্ডের অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তি। তাঁদেরই এক জন তিনি কবি ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডর। সদ্যোজাতের ধর্মপিতার ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তাঁর নামেই নামকরণ করা হয় ওয়াল্টারের। পার্ক স্ট্রিট সমাধিক্ষেত্রেই শায়িত রয়েছেন ল্যান্ডরের একটি কবিতার অনুপ্রেরণা রোজ় অ্যালমার। তরুণ কবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বন্ধ করতে অষ্টাদশী রোজ়কে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে শোনা যায়। শহরে আসার দু’বছর পরেই কলেরায় মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে একটি শোকবার্তা পাঠান ল্যান্ডর। সেটি স্থান পেয়েছে রোজ়ের সমাধিতেই। নিজের দেশ, পরিজনেদের কাছে ফিরে যেতে পারেননি তরুণ ওয়াল্টার। তবে
তাঁর স্মৃতিফলকটি পার্ক স্ট্রিট সমাধিক্ষেত্রে স্থানান্তরিত করার ফলে এক প্রিয়জনের সঙ্গে ক্ষীণ হলেও তৈরি হয়েছে একটি যোগসূত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy