রাজাবাজারে সিগন্যাল না মেনেই রাস্তা পারাপার অটোর। ছবি: সুমন বল্লভ
গড়িয়া মোড়ের কাছে পাঁচ নম্বর বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা সে দিন সকাল সকাল রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল। ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাতটি অটো। রাস্তায় ছড়িয়ে কাচ। এর কিছু ক্ষণ পরেই একদল লোক সেখানে ঢুকে ফুটপাতের দোকানগুলি ভাঙতে শুরু করে। আছড়ে ভাঙা হয়েছিল হকারদের কাচের জিনিস, ফুলের টব! তাণ্ডবের জেরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকে রাজা এস সি মল্লিক রোড।
দ্রুত পৌঁছেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নাকাল হয়েছিল পুলিশ। আহত কয়েক জনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে আর কিছু লোককে গ্রেফতার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। জানা গিয়েছিল, একটি রাজনৈতিক দলের সৌধের সামনে ফুটপাতে এক হকারকে বসতে না দেওয়া নিয়ে গোলমাল শুরু হলেও আদতে তা হকার সিন্ডিকেট এবং অটো সিন্ডিকেটের লড়াই!
গত কয়েক মাস ধরে সিন্ডিকেটের লড়াইয়ের এমন একাধিক ঘটনা প্রায়ই সামনে আসছে। পুলিশ ধরপাকড় চালিয়েও
পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না বলে অভিযোগ। এক সময়ে নির্মাণ ব্যবসা ঘিরে সিন্ডিকেটের জুলুমের সূত্রপাত হয়েছিল। এখন গণপরিবহণ, হকারি, পার্কিং-ও সে পথে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সমস্যা বেড়েছে বলে দাবি। অনেকে বলছেন, ‘‘বিনিয়োগ ছাড়া শুধু বাহুবলে আয় করতে প্রায় সবেতেই তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট! ফলে সিন্ডিকেটের লড়াইয়ে ছড়াচ্ছে হিংসা।’’ ভুক্তভোগীদের দাবি, করোনা পরিস্থিতির ‘আনলক’-পর্বের শুরু থেকেই শহরে সিন্ডিকেটের সব চেয়ে বেশি রমরমা চলছে অটো, ট্যাক্সির মতো গণপরিবহণের ক্ষেত্রগুলিতে। অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতা-দাদার ‘আশীর্বাদ-ধন্য’ সিন্ডিকেটের মাথারাই ঠিক করছেন, কোন রুটে ক’টা অটো চলবে, কোথায় ট্যাক্সির স্ট্যান্ড হবে, অথবা দিনের আয়ের কত ভাগ চালক বা মালিক দেবেন সিন্ডিকেটকে। দাদাদের খুশি করলেই ট্র্যাফিক গার্ডের ঝামেলা পোহাতে হয় না। রুটে প্রয়োজন না থাকলেও অটো নামাতে সমস্যা হয় না।
দক্ষিণ কলকাতার এক সিন্ডিকেট-সদস্য অটোচালক বললেন, ‘‘এই শহর ও শহরতলি মিলিয়ে অটোর প্রায় ৫১০টি নথিভুক্ত রুট রয়েছে।
তবে চাইলেই নতুন অটো নামানো যায় না। কারণ, রুট-পিছু কত অটো চলছে বা ক’টা অটো থাকতে পারে, সেই সংখ্যা তালিকাবদ্ধ থাকে। পুরনো অটো এখন চলার অযোগ্য, সেই প্রমাণ দাখিল করা ছাড়াও অটো ধ্বংসের প্রক্রিয়ার ভিডিয়ো করে প্রশাসনে পাঠাতে হয়। তার পরে নতুন অটো নামানোর ছাড়পত্র মিললে তবেই এগোনো যায়। কিন্তু সিন্ডিকেটের দাদাদের আশীর্বাদ যাঁদের সঙ্গে থাকে, তাঁদের জন্য এই সব নিয়মই খাতায়কলমে।’’
আশীর্বাদের খরচ কত? উত্তর কলকাতার এক অটোচালক বলেন, ‘‘দাদাদের খুশি করতে চার লক্ষ টাকার অটো ৯-১০ লক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়।’’ শিয়ালদহ স্টেশনের একটি স্ট্যান্ডের ট্যাক্সিচালক আবার বলেন, ‘‘সিন্ডিকেটে থাকতে প্রথম বার এককালীন টাকা দিতে হয়েছে। মাসে মাসে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দিলেই হয়। দু’দিন আগেই শিয়ালদহ স্ট্যান্ড নিয়ে দুই সিন্ডিকেটের ঝামেলা হয়েছে। নতুনেরা দখল নিলে কত চাইবে জানি না। টাকার খেলা চলে যখন, তখন তো রেষারেষি হবেই।’’
একই রকম অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন গড়িয়াহাটের এক হকার। তিনি জানাচ্ছেন, গড়িয়াহাট, ভবানীপুর, গোলপার্কের মতো একাধিক এলাকার ফুটপাতের প্রতি বর্গফুট জায়গার জন্য ৩০০০-৩৫০০ টাকা করে তোলা হচ্ছে। কয়েক জন হকার এক নেতা-দাদার আশীর্বাদেই এমন সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন। সেখানে টাকা দিতে পারলে স্টলের জন্য লোহার কাঠামো পেতে সমস্যা হয় না। আলো-পাখার বন্দোবস্তও হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘‘এর পরেও প্রতি দিন দশ টাকা দিতে হয়। সেই টাকায় নাকি বসার স্টুল আর টেবিল দেওয়া হয়। বাড়ি থেকে সে সব আনলেও এই টাকা দিতেই হবে! নতুন একটা দল নয়া সিন্ডিকেট করছে। গড়িয়াহাট নিয়ে ঝামেলা লাগল বলে!’’
সিন্ডিকেটের গোলমালের খবর উল্টোডাঙা মেন রোডেও। সেখানে আগে রাজ্যের মন্ত্রী এবং তাঁর
অনুগামী কাউন্সিলরদের ছবি-সহ লোহার স্টল বানানো হয়েছিল ফুটপাতের কিছুটা জুড়ে। টাকার বিনিময়ে সেই সব স্টলে হকার বসানো হয়েছিল বলেও অভিযোগ। করবাগান এলাকার বাসিন্দা, তাঁদেরই এক জন মুচকি হেসে বললেন, ‘‘এত দিন ওই নেতার হিসাব চলত। এখন তাঁর অবর্তমানে দুই নেতার স্নেহধন্য দু’টি সিন্ডিকেটের লোকজন এসে আলাদা আলাদা বোঝাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত কে দখল নেয়, সেটাই দেখার।’’
আর এই দখলদারির লড়াইয়েই কি পর পর হিংসার ঘটনা ঘটছে? কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। শুধু বলেছেন, ‘‘এত ভয়ের কিছু নেই। সব গন্ডগোল পুলিশ সামলে দেবে।’’ পাইকপাড়ার বাসিন্দা এক ব্যবসায়ী যদিও
বললেন, ‘‘খালপাড়ের দখলদারি ঠেকাতে পুরসভা পার্কিংয়ের দরপত্র ডেকেছিল। দু’লক্ষ ৯০ হাজারে সেই দরপত্র নিয়েও ব্যবসা করতে পারিনি। বহু জায়গায় অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। টাকা খেতে সবাই পিছনে লেগে গিয়েছিল। এক সিন্ডিকেট টাকা নিয়ে গেলে আর এক দল ঝামেলা করত! শেষে ব্যবসাটাই তুলে দিতে হয়!’’
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy