হাসপাতালের এক কোণে একটি শিশুকে আঁকড়ে ধরে বসেছিলেন মঞ্জু মাহাতো।
হাসপাতালের এক কোণে একটি শিশুকে আঁকড়ে ধরে বসেছিলেন মঞ্জু মাহাতো। বুধবার সন্ধ্যায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ জুড়ে তখন আতঙ্ক, আর্তনাদ আর দিশেহারা পরিজনদের ছোটাছুটি। সেদিকেই বিহ্বল হয়ে তাকিয়েছিলেন বছর পঞ্চাশের মঞ্জু। যিনি তার কিছুক্ষণ আগে বেঁচে ফিরেছেন এ জে সি বসু রোড উড়ালপুলের উপর উল্টে-যাওয়া অভিশপ্ত ম্যাটাডরের তলা থেকে।
বর্ধমানের বাসিন্দা মঞ্জু কলকাতায় এসেছিলেন প্রয়াত আত্মীয় গুলাবি মাহালির ঘাটকাজে যোগ দিতে। বালিগঞ্জের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন। বুধবার বাবুঘাটে দশদিনের ঘাটকাজ ছিল গুলাবির। পাড়া-পড়শি এবং পরিজনরা একটি মাঝারি মাপের ম্যাটাডরে বোঝাই হয়ে গিয়েছিলেন বাবুঘাটে। সেখান থেকে ফেরার পথেই বিপত্তি। মঞ্জু বলছিলেন, ‘‘ড্রাইভার ফেরার সময় শুরু থেকেই প্রচন্ড জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল। বার বার বললেও কান দেয়নি। ওর নাকি পরে আরও একটা ট্রিপ ছিল।’’
এক আত্মীয়ের সন্তানকে কোলে নিয়ে মঞ্জু বসেছিলেন ম্যাটাডরের মেঝের উপর। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলেন, গাড়ির গতি ক্রমশ বাড়ছে। ভয় করছিল তাঁর। শিশুটিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন আরও জোরে। আচমকাই প্রচন্ড জোরে ব্রেক কষে ম্যাটাডরটি। তার পরেই বিকট শব্দে উল্টে যায়। মঞ্জুরা চাপা পড়েন উল্টোন ম্যাটাডরের নীচে।
আরও পড়ুন: বেপরোয়া গতিতে নজর পুলিশের, বড়দিনে কলকাতায় বাড়ল নিরাপত্তা
পুলিশ জানাচ্ছে, বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে পার্ক সার্কাসের দিকে নামার মুখে ম্যাটাডরটি প্রচন্ড গতিতে চলতে চলতে আচমকা ব্রেক কষে। তার অভিঘাতেই গাড়িটি প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। তার পর উল্টে পড়ে ঢালের মুখে। মঞ্জু জানাচ্ছেন, দুর্ঘটনার পর তিনি খানিকক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। খানিক পরে যখন জ্ঞান ফেরে, শোনেন চারদিকে আর্তনাদ আর গোঙানির শব্দ। দেখেন, পুলিশ এসেছে। তাঁকেও হাত ধরে টেনে তোলে পুলিশ। উড়ালপুলে বসে থাকতে থাকতে মঞ্জু দেখেন, একের পর এক মানুষকে টেনে বার করা হচ্ছে উল্টোন গাড়ির তলা থেকে। চারদিকে রক্ত। জামাকাপড় ছিঁড়ে পড়ে রয়েছে। ছড়িয়েছিটিয়ে আছে চপ্পল আর জুতো।ভেবেছিলেন, সকলেই মারা গিয়েছেন। ওগুলো সব লাশ। নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন। প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন বলে। একটু ঠাহর করে দেখেন, বেঁচে গিয়েছে কোলের শিশুটিও। তাকে কোলে নিয়েই তিনি আত্মীয়দের খোঁজে যান হাসপাতালে।
সেখানে তখন ট্রলিতে করে একের পর এক আহতের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছেন নানাদিক থেকে আত্মীয়-পরিজনরা। সকলেই উদ্বিগ্ন। শঙ্কিত। আতঙ্কিত।
মৃত গুলাবির ঘাটকাজের জন্য বাবুঘাটে গিয়েছিলেন প্রতিবেশি প্রদীপ রায়। দুর্ঘটনায় তাঁর একটি হাত কাটা পড়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে প্রদীপের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রদীপের ছেলের কান কেটে ঝুলছে। আহত হয়েছেন মোট ২৯ জন। ১৫ জন পুরুষ। ১৪ জন মহিলা। তাঁদের মধ্যে প্রদীপ-সহ সাতজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিশেষত প্রদীপের। মঞ্জু বলছিলেন, ‘‘ঘাটকাজে এসে যে এই অবস্থায় পড়ব, কখনও ভাবিনি। বাড়ির লোক আমার বেঁচে থাকার খবর পেয়েছে কি না, তা-ও জানি না। বেঁচে আছি, সেটাই ভাবতে অবাক লাগছে।’’
আরও পড়ুন: এজেসি বসু রোড উড়ালপুলে গাড়ি উল্টে আহত ২৪
হাসপাতাল জুড়ে তখনও উদ্বেগ, আশঙ্কা, আতঙ্ক। এক কোণে বসে কোলের শিশুকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরলেন মঞ্জু মাহাতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy