সান্ধ্য মজলিসের আগে ইমামবাড়া সাজাচ্ছেন বাড়ির মেয়েরা। পেমেন্টাল স্ট্রিটে। —নিজস্ব চিত্র।
ইমামবাড়ার তাজিয়ার পাশে জনাবে আলি আসগরের দোলনার শিশুশয্যা। সে দিকে তাকিয়ে ছ’মাসের ভাই আলি আসগরের জন্য পাঁচ বছরের দিদি সাকিনার কান্নার কথা বলছিলেন গৃহকর্ত্রী নুজহাত জাহরা। কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসেনের সঙ্গীদের হত্যার সময়ে দুধের শিশুটিকেও ছাড়েনি এজিদের দলবল। দোলনা দেখে বড়দিনের জিশুর শিশুশয্যা মনে আসবেই! শুনে নুজহাতের স্বামী কামরান আলি মির্জা বললেন, “জন্মাষ্টমীর কৃষ্ণের জন্মোৎসবের সাজগোজের সঙ্গেও মিল। তবে মহরমের অনুষ্ঠান, আজাদারির এই সাজসজ্জা হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়!”
রিপন স্ট্রিট লাগোয়া পেমেন্টাল স্ট্রিটের ইমামবাড়ার সঙ্গে জড়িয়ে একটি পরিবারের প্রতিরোধ-কাহিনিও। কলকাতায় নির্বাসিত রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের পুত্র বির্জিস কাদর খুন হলে এখানেই পালিয়ে আসেন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মহতাব আরা বেগম। তিনি আবার মোগল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরের নাতনি। ১৮৯৮ সালে শুরু হয় পারিবারিক ইমামবাড়ার অনুষ্ঠান। তাতে আজও জড়িয়ে কলকাতায় খানদানি লখনউয়ি আজাদারি (শোকপালন) এবং এ শহরের পূর্বনারীদের হার না-মানা সাহসের স্মারক।
মহতাব আরার প্রপৌত্রী, ওয়াজিদ আলি শাহের বংশের মেয়ে, বিরিয়ানি-বিশারদ মনজ়িলাত ফতিমাকে মহরম মাসে এ বাড়ির সান্ধ্য মজলিসে দেখা যাবে। তাঁর দিদি, অবসরপ্রাপ্ত আইনশিক্ষিকা তালাত ফতিমাও এ সময়ে রাজস্থানের ঢোলপুরের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে কলকাতাতেই থাকবেন। মহরমে ইমামবাড়ায় মেয়েদের সান্ধ্য মজলিস কলকাতার বিশেষ পরম্পরা। মেটিয়াবুরুজের খসরুল বুকা ইমামবাড়াও শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য।
পেমেন্টাল স্ট্রিটে মহরম মাসের প্রথম দশ দিনই মজলিস বসে। পাড়ার মেয়েরা, কারবালার শোকগাথা শুনতে আসা হিন্দু, খ্রিস্টান মহিলাদের ভিড়ও উপচে পড়ে ইমামবাড়ায়। ছেলেরা তখন বাড়ির বাইরে থাকেন। মহরম মাসের ১০ তারিখ বা আশুরাই সব থেকে বিশেষ দিন। ইমাম হুসেন সে দিন শহিদের মৃত্যুবরণ করেন। তালাত ফতিমা বললেন, “মহরম মাসের ন’তারিখ রাতটায় রাজস্থানের নবরাত্রির শেষ রাত বা বাংলার নবমীর কথা মনে পড়ে। অতিথি-বন্ধুদের সঙ্গে রাতভর গল্পে কাটে। ইমামবাড়ার তাজিয়া, দোলনা সবই আশুরার দিন পর্দায় ঢেকে ফেলি। ওই দিন সালামও (শান্তিকামনার সম্ভাষণ) বন্ধ রাখি!”
এর আগের সান্ধ্য শোক-পার্বণে বছর বছর একই দৃশ্য। তালাত বলছিলেন, “মহতাব আরার পরে তাঁর বৌমা, আমাদের দাদিজান সব সামলাতেন। তিনি মারা গেলে আমার মা বদরুন্নিসা নকভি দায়িত্ব নেন। আম্মা কবি ছিলেন। মহরমে কারবালার শোকের কবিতা নৌহা লিখতেন। সেই সব নৌহার সঙ্গে বুকে চাপড় মেরে শোকপ্রকাশ বা মাতমের রীতি।” এক গল্প বার বার শুনলেও চোখে জল আসে মেয়েদের। ইমাম হুসেনরা মারা যেতে তাঁর বোন জনাবে জয়নাবই প্রথম মহরমের আজাদারির মজলিস বসান। সেও স্বামী-পুত্র-ভ্রাতৃহারা এক নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর স্পর্ধা। তালাত বললেন, “মজলিসের কান্নার মধ্যে যে কত যুগের যন্ত্রণা মিশে। মা, দাদিদের কথা ভেবেও কাঁদি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy