স্বপ্নচ্ছেদ: ময়না-তদন্তের প্রস্তুতিতে আনন্দ মল্লিক, ভিকি মল্লিক ও সঞ্জয় মল্লিক। বুধবার, এসএসকেএমে। নিজস্ব চিত্র।
অন্য অনেকের মতো ওঁদেরও স্বপ্ন ছিল, সামনে থেকে এক বার তাঁকে দেখার। কিন্তু সুযোগ ছিল না। বুধবার সকালে সেই ‘সুযোগ’ যখন এল, তখন ময়না-তদন্তের টেবিলে শুয়ে রয়েছেন ‘তড়প তড়প কে ইস দিল সে…’র গায়ক কেকে। যাঁকে স্পর্শ করার বিস্ময়ের পরে নিথর দেহ ব্যবচ্ছেদের জন্য ছুরি-কাঁচি এগিয়ে দিতে গিয়ে হাত কেঁপে গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরেও যেন সেই ঘোর কাটছিল না এসএসকেএমের মর্গের তিন কর্মীর।
ওই দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা ময়না-তদন্তের গোটা প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন আনন্দ মল্লিক, ভিকি মল্লিক ও সঞ্জয় মল্লিক। মর্গের পিছনের কোয়ার্টার্সের বাসিন্দা ওই তিন কর্মীর কাছেই সে দিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক ইন্দ্রাণী দাসের ফোন গিয়েছিল। জানানো হয়েছিল, সকাল ১০টার মধ্যে আসতেই হবে। অবাক হয়ে বছর বত্রিশের আনন্দ পুনরায় ফোন করে জানতে চান, ‘‘ম্যাডাম, বিশেষ কিছু ঘটেছে?’ উত্তরে শোনেন, ‘‘ভিআইপি-র দেহের ময়না-তদন্ত হবে। সিএমআরআই হাসপাতাল থেকে আসবে।’’ তখনও ওঁরা বুঝতে পারছিলেন না, কেন জরুরি তলব।
নিয়মানুযায়ী কার দেহের ময়না-তদন্ত হবে, তা আগাম জানানো হয় না ওই ময়না-তদন্ত সহকারী বা ডোমেদের। কাজে যোগ দেওয়ার পরে তাঁরা জানতে পারেন। এ দিন ভিকি বলেন, ‘‘বাড়ি থেকে বেরোনোর তাড়া ছিল। তখনই টিভি-র খবরে এক ঝলক দেখলাম, কেকে-র দেহ ময়না-তদন্তের জন্য এসএসকেএমে আনা হবে। ভাবতে পারছিলাম না, এটা কি সত্যি!’’ প্রায় সাত বছর ধরে পিজি-র মর্গে চাকরি করছেন বাণিজ্য বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা ভিকি এবং অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ আনন্দ। বছর পঁয়তাল্লিশের সঞ্জয় অবশ্য প্রায় ১০ বছর ধরে মর্গে কর্মরত। এত বছরের কর্মজীবনে অসংখ্য দেহের ময়না-তদন্তে সহযোগীর কাজ করেছেন। সঞ্জয় বলেন, ‘‘ওই টেবিলে সকলেই আমাদের কাছে সমান। কিন্তু তা-ও যেন মনের ভিতরে একটা কষ্ট হচ্ছিল।’’
শববাহী গাড়ি পিজি-র মর্গে পৌঁছনোর পরে কেকে-র দেহ নামিয়ে তা সরাসরি ব্যবচ্ছেদের ঘরে নিয়ে গিয়ে টেবিলে তোলার সময়ে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না আনন্দের। বললেন, ‘‘ওম শান্তি ওম সিনেমার ‘আঁখো মে তেরি আজব সি’র গায়ককে হাতে ধরে টেবিলে শোয়াচ্ছি, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল! মনে হচ্ছিল, উনি যেন ঘুমোচ্ছেন।’’ ময়না-তদন্তের জন্য প্রস্তুত হয়েও থমকে গিয়েছিলেন কিছু সময়। এক সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে নন্দন চত্বরে আড্ডা দেওয়া ভিকির কথায়, ‘‘যাঁর এত সব জনপ্রিয় গান শুনেছি, তাঁকে এক বার সামনে থেকে দেখার স্বপ্ন তো সকলের থাকে। কিন্তু তাঁকে যে ওই অবস্থায় দেখব, তা কল্পনাও করিনি।’’ ব্যবচ্ছেদের পরে শিল্পীর দেহ সেলাই করেন আনন্দ, ভিকিরা। স্নান করিয়ে প্রিয় গায়ককে পরিপাটি করে হাসপাতালেরই দু’টি সাদা চাদরে মুড়ে কফিনে শুইয়ে পুলিশের শববাহী গাড়িতে তুলে দেন তাঁরা।
গত বছর পূর্ব রেলের সদর দফতরে আগুনে পুড়ে কাঠকয়লার মতো হয়ে যাওয়া ন’টি দেহের সারা রাত ধরে হওয়া ময়না-তদন্তেও ছিলেন এই তিন জনই। বললেন, ‘‘কিছু কিছু ঘটনায় হয়তো ক্ষণিকের কষ্ট হয়। কিন্তু এই ঘটনা সারা জীবন মনে থাকবে।’’ বাড়ি ফেরার পরে পরিজন, বন্ধুদের প্রশ্ন ছিল, ‘‘কী দেখলি? কী হয়েছিল?’’ রাতে স্ত্রী প্রীতি মোবাইলে চালিয়েছিলেন ‘তুহি মেরি সব হ্যায়’। তাঁকে থামাতে বলেছিলেন ভিকি। বললেন, ‘‘চোখের সামনে বার বার টেবিলে শোয়ানো মুখটা ভেসে উঠছিল।’’ আর আনন্দ বলছেন, ‘‘হম রহে ইয়া না রহে কাল-এর শিল্পীকে ছোঁয়ার সময়ে মনে হচ্ছিল, স্যর আপনি থাকবেন, আপনার গানে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy