একা: পথ চলতে লাঠিই ভরসা প্রবীণদের। শনিবার, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে ফোন এসেছিল এক প্রবীণের। নিজের নাম, বয়স বলার পরে বাড়ির ঠিকানা বলা শুরু করতেই ফোন কেটে যায়। এর পরে পুলিশ কয়েক বার ফোন করলেও কেউ ধরেননি। পুরো ঠিকানা বা কী সমস্যা নিয়ে তিনি ফোন করেছিলেন, জানা যায়নি। কয়েক দিন বাদে সংশ্লিষ্ট অফিসার খবরে দেখেন, সেই নামেরই এক প্রবীণের মৃত্যু হয়েছে। বয়সও মিলে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে ওই অফিসার জানতে পারেন, বৃদ্ধের বাড়ি বেহালায়। ছেলে বিদেশে চাকরি করেন। বাবার জন্য সর্বক্ষণের আয়া রেখেছিলেন। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই বৃদ্ধের কপালে জুটত আয়ার মার! ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ফেলে রাখা হত বৃদ্ধকে। সেই ওষুধই বেশি মাত্রায় শরীরে যাওয়ায় মৃত্যু!
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন অভিযোগ সামনে আসে প্রায়ই। বহু ক্ষেত্রেই অপরাধের খবর পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছয় না। আশঙ্কার বিষয়, সাধারণ মানুষেরও এ নিয়ে তেমন সচেতনতা নেই। প্রবীণেরাও জানেন না তাঁদের অধিকার সম্পর্কে। আজ, রবিবার বিশ্ব প্রবীণ দিবসে সচেতনতার অভাবের এই দিকটিই সব চেয়ে বড় চিন্তার বিষয় বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের। তাঁরা জানাচ্ছেন, এই কারণেই রাষ্ট্রপুঞ্জ এ বছরের বিশ্ব প্রবীণ দিবসের থিম ঘোষণা করেছে, ‘ফুলফিলিং দ্য প্রমিসেস অব দি ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস ফর ওল্ডার পার্সনস: অ্যাক্রস জেনারেশনস’। অর্থাৎ, বয়স্কদের জন্য মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার প্রতিশ্রুতি পূরণে সমস্ত প্রজন্মের সচেষ্ট হওয়া। যা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, তবে কি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা বাস্তবে পূরণ হচ্ছে না বয়স্কদের ক্ষেত্রে? সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনায় দেখা গিয়েছে, দমদমে এক বৃদ্ধকে খুন করে পালিয়ে যায় তাঁর গাড়িচালক। অন্য ঘটনায় আয়ার হাতে মারধর খাওয়ার পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এক বৃদ্ধাকে।
কলকাতা পুলিশের কমিউনিটি পুলিসিং বিভাগই দেখেছে, প্রতি সাত জন প্রবীণের মধ্যে অন্তত তিন জন নির্যাতনের শিকার। এঁদের মধ্যে ৩২ শতাংশ আত্মীয়দের দ্বারা, ২১ শতাংশ বন্ধু বা দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্তদের দ্বারা এবং ২০ শতাংশ প্রতিবেশীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার। বাকিরা সরাসরি সন্তান এবং সন্তানের সঙ্গীদের হাতে নির্যাতিত। যে সমস্ত প্রবীণ একা থাকেন (৮.২ শতাংশ) এবং যাঁরা সন্তানদের সঙ্গে থাকলেও জীবনসঙ্গীকে হারিয়েছেন (৫.৪ শতাংশ), তাঁদের উপরে নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে। আবার ‘ইউএন পপুলেশন প্রসপেক্টস’ অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের ২০ শতাংশ জনসংখ্যার বয়স ৬০ বছর বা তার উপরে গিয়ে দাঁড়াবে। তবে আশার কথা, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দিতে ‘দ্য মেনটেনেন্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজ়েন্স ল, ২০০৭’ হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্যাতনের নানা রূপ নিয়ে এখনও তেমন সচেতনতা নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রবীণেরা নির্যাতিত হতে পারেন শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে। হতে পারে যৌন নির্যাতনও। শারীরিক ও যৌন নির্যাতন নিয়ে ধোঁয়াশা নেই। কিন্তু দোষ দেওয়া, হুমকি দেওয়া, বকুনি, অপমান, দিনের পর দিন অবহেলার মতো বিষয়কে যে আবেগে আঘাত হিসাবে দেখা হয়, অনেকেই তা জানেন না। এই সূত্রেই আসে মানসিক নির্যাতনের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি, সম্পত্তি চুরি, এটিএম, ক্রেডিট কার্ড ও পাসবইয়ের অপব্যবহার, জোর করে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র হাতবদল অর্থনৈতিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। দীর্ঘদিন প্রবীণদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক সদস্য বললেন, ‘‘আর একটি নির্যাতন হল, অসুস্থতাকে গুরুত্ব না দেওয়া। দিনের পর দিন না দেখার দরুণ কোনও প্রবীণের হয়তো বেডসোর হয়ে গেল! সে ক্ষেত্রেও চাইলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’’
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এই অসহায়তা দূর করার জন্য ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা আরম্ভ হয়। শেষে ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বয়স্কদের অধিকার সংক্রান্ত ১৮ দফা সনদ ঘোষণা করা হয়। ভারতের সংবিধানেও বয়স্ক নাগরিকদের জীবনযাপন মসৃণ করতে এবং তাঁদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার নিয়ে নানা কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে, বেঁচে থাকার অধিকার মানে শুধুমাত্র পশুর জীবন অতিবাহিত করা নয়। ভারত সরকারের ‘রিজিয়োনাল রিসোর্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট অব জেরন্টোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী বললেন, ‘‘কোনও একটা দিন পালন করা মানেই অধিকার সুরক্ষিত হওয়া নয়। সাধারণ মানুষকে নিজের অধিকার বুঝতে হবে, পুলিশ-প্রশাসনকেও এ বিষয়ে আরও সক্রিয় হতে হবে।’’ সেই সক্রিয়তা কি দেখা যায়? বাস্তব চিত্র বহু ক্ষেত্রেই অন্য কথা বলে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy