Advertisement
E-Paper

ক্লাস শেষে হাতে হাতে ‘স্যরের’ দেওয়া রক্তকরবী

ছাত্রদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া, গলার অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়েও যে কোনও ‘হাবিজাবি’ প্রশ্নের জবাব দিতে অক্লান্ত মাস্টারমশাইটির যে বিগ্রহ তিলে তিলে গড়ে উঠেছে তাঁকে সচরাচর রাগতে দেখেননি কেউ।

বাড়িতে একান্তে কবি শঙ্খ ঘোষ।

বাড়িতে একান্তে কবি শঙ্খ ঘোষ। নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২১ ০৬:২৯
Share
Save

এই স্মার্টফোনের যুগে তিনি কতটা রেহাই পেতেন, কে জানে! তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের চাপাচাপি উপেক্ষা করে তাঁর ক্লাসের পড়ানো, ভিডিয়ো বা টেপে রেকর্ড করতে দিতে শঙ্খ ঘোষ কিছুতেই রাজি হননি।

ক্লাসে ঢুকেই সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে দিতেন তিনি। পড়ানো শেষ করে ব্ল্যাকবোর্ডের সবটুকু স্বাক্ষর নিজের হাতে ডাস্টারে নিশ্চিহ্ন না-করে শান্তি নেই! ক্লাস চলবে, নদীর মতো ঝরঝরে মসৃণ ভঙ্গিতে। কিন্তু পড়ানোর ফাঁকে ভুলেও কখনও ‘রেফারেন্স’ হিসেবে নিজের লেখা বইয়ের নাম বলবেন না ‘স্যর’। এমন মাস্টারমশাইয়ের ক্লাস বহু দশক পার করেও চোখ বুজলে অনায়াসে দেখতে পান অসংখ্য পড়ুয়া। এ বিষয়ে যাদবপুরে ১৯৭১-এর বাংলার এমএ পূরবী ভট্টাচার্য, ১৯৮০-র সৌমিত্র বসু বা ১৯৯২-এ স্নাতকোত্তরের পাট চোকানো অভীক মজুমদারে বিশেষ পার্থক্য নেই।

অজিত দত্ত, দেবীপদ ভট্টাচার্য, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বা শঙ্খ ঘোষের মতো কিংবদন্তিপ্রতিম শিক্ষককুলের সান্নিধ্যধন্য যাদবপুরের প্রাক্তনীদের ‘পুনশ্চ বাংলা’ মঞ্চটির অনেকের কাছেই ক্লাসে, ক্লাসের বাইরে পরম আশ্রয় ‘স্যর’। বেথুন স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা পূরবীর চোখে যেমন ‘রক্তকরবী’র ‘রাজা’ মানে ‘শঙ্খদা’ স্বয়ং। যাদবপুরের বাংলা বিভাগের ছাত্র এবং অধ্যাপক সৌমিত্রবাবুর আবার মনে আছে, কী ভাবে সাহিত্যপাঠকে সহজ ভাবে জীবনের সঙ্গে ‘স্যর’ মিলিয়ে দিতেন। রক্তকরবী ক্লাসের প্রথম দিন সবাইকে বলা থাকত নাটকটা নিজেরা পড়ে আসতে। তার পরে সবাইকে নিজের ভাষায় গল্পটা বলতে হত। সৌমিত্রবাবু বলছেন, “সে যেন এক মজার খেলা। গল্পটা বলার সময়ে কেউ এক বারও নন্দিনী বা রাজা অমুকের প্রতীক বা এ নাটক তমুকের রূপক বলে ফেললেই ‘স্যর’ থামিয়ে দেবেন! আলগা ভাবে বলা ভারী শব্দের মোড়ক তিনি বরদাস্ত করবেন না।” এক বার যাদবপুরেই ছিটেফোঁটা বাংলা না-জানা কোনও বিদেশি বা ভিন্ ভাষীদের জন্য বাংলা পাঠ্যক্রম প্রসঙ্গে শঙ্খবাবুর পরামর্শ ছিল, রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ তাঁদের ভাল লাগবে। শুধু জীবাত্মা-পরমাত্মার তত্ত্বটত্ত্ব ঢুকলেই চিত্তির। যাদবপুরের শিক্ষকমহলেও তখন তিনি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক চলমান ‘আর্কাইভ’। কিন্তু তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়তে আসা বাদল সরকারকে কিছুতেই রক্তকরবীর ক্লাসে বসতে দেননি। শঙ্খ ঘোষের সেই ‘ভয়’ নিয়েও তখনকার শিক্ষকমহলে কত হাসিমজা!

স্কুলপড়ুয়াদের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে।

স্কুলপড়ুয়াদের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে।

আসলে ভয় নয়! স্বভাব কুণ্ঠিত সদা নিচু তারে বাঁধা এই মাস্টারমশাইয়ের কাঠামোটা ঠিক সাধারণের জ্ঞানবুদ্ধিতে ধরা পড়ত না, বলছিলেন শঙ্খবাবুর অন্যতম প্রিয় ছাত্র, পরে যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক অভীক মজুমদার।

বহরমপুর গার্লস কলেজ, সিটি কলেজ ইত্যাদি শিক্ষাঙ্গনে ঘুরে ১৯৬০-এর দশকের গোড়াতে যাদবপুরে স্থিত হন কবি-শিক্ষক। নিজে পিএইচডি করেননি। যাদবপুরে চাকরির ইন্টারভিউয়ে তাঁর বিচ্ছুরণে মুগ্ধ সুকুমার সেন নাকি বলেছিলেন, ‘ও নিজেই পিএইচডি করাবে!’ বাস্তবিক শঙ্খ ঘোষকে কোনও ডিগ্রির ফিতেয় মাপাও যায় না। তবে কারও কারও মনে পড়ছে, পরে পরে বাম আমলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে তাঁর নাম আলোচিত হয়েও বাস্তবায়িত হয়নি। ওই যে পিএইচডি নেই! তবে কি না যাঁকে উপাচার্য করা হয়, তাঁরও তখন পিএইচডি ছিল না। শঙ্খবাবু অবশ্য নিখাদ পড়ানোর আনন্দে পড়িয়েছেন। শান্তিনিকেতনে ফেলোশিপ-পর্বে উৎসাহ ভরে পাঠভবনের ছোটদের ক্লাসও তিনি নিয়েছেন। ক্লাসে এক জন শিক্ষক কতটা মেথডিক্যাল বা শৃঙ্খলাবদ্ধ কিন্তু শুকনো পণ্ডিতিমুক্ত সরস হতে পারেন তা বিশদে লিখেছেন অভীক। ১৯৯২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যাদবপুরে তাঁর স্বেচ্ছাবসর। অভীকের মতে, “বাংলা সাহিত্য পঠনপাঠনের জগতে একটা যুগাবসান।” কিন্তু শঙ্খবাবুর বাড়ির রবিবারের আড্ডাও বরাবর কত জনের সংস্কৃতি বা জীবনবোধের আশ্রয়। সহনশীলতা, ক্ষমা, স্নেহে আমৃত্যু বটগাছের মতোই তিনি ছায়া দিয়েছেন।

শঙ্খবাবুর আর এক প্রিয় ছাত্র অকালপ্রয়াত কবি জয়দেব বসুর স্ত্রী সেবন্তী ঘোষ যেমন বলেন, “জয়দেবকে মজা করে কত বার বলেছি, নেহাত স্যর আমাদের বিয়ের কাগজে সই করেছিলেন, তাই ভাঙতে পারছি না!” সেবন্তী নিজেও বাড়িতে খুঁজে পেয়েছেন, রাজনীতিতে ব্যস্ত, যাদবপুরের ফাঁকিবাজ ছাত্র জয়দেবের জন্য স্যরের আপৎকালীন দাওয়াই। শাড়ির ভাঁজের ভিতরের লম্বা কাগজে লিখে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় লেখালেখির কালানুক্রমিক ফর্দ, যা এক বার দেখলে মুখস্থ বা হৃদয়স্থ হওয়া অনেক সহজ। শঙ্খবাবুর বিখ্যাত সব সারণি কখনও পাশাপাশি রেখেছে বাংলা, ইংরেজি ও ইউরোপীয় সাহিত্যর উনিশ বা বিশ শতকের স্মরণীয় কবিদের ক্রম। বিশ্বনাটকের বিবর্তন বোঝাতেও বিভিন্ন সময়কালের প্রতিনিধিকে সাল সমেত তুলে ধরছে। ছাত্রদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া, গলার অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়েও যে কোনও ‘হাবিজাবি’ প্রশ্নের জবাব দিতে অক্লান্ত মাস্টারমশাইটির যে বিগ্রহ তিলে তিলে গড়ে উঠেছে তাঁকে সচরাচর রাগতে দেখেননি কেউ। যাদবপুরে বিভাগের কোনও অনুষ্ঠানে সবার খাওয়া হওয়া পর্যন্ত মায়ের মতো অপেক্ষা করবেন তিনি! জয়দেব বসু এক বার মজা করে ‘স্যর’কে বিড়ম্বনায় ফেলতে ‘অশ্বতর’ শব্দের মানে জিজ্ঞেস করেছিলেন। শঙ্খ ঘোষের মুখে কোনও অপশব্দ, কেমন শোনাতে পারে, তাও বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতি অনুরাগীদের দারুণ কৌতুকের বিষয়। অভীক বলছিলেন, “অপশব্দ নিয়ে স্যরের এই লাজুক স্বভাব, আবার সবার প্রতি চরম সহিষ্ণুতার জন্য যাদবপুরে নামকরণ হয়, ‘ভদ্র বড়, স্বাভাবিক নয়’! কিন্তু এটা আসলে মানুষটার ওপর-ওপর পরিচয়!” অভীকের কথায়, “প্রতিবাদের স্পর্ধায় এই ভদ্র মানুষটাই তো বেপরোয়া। কিন্তু তাঁর লেখার ভঙ্গি, ক্লাসে বা ক্লাসের বাইরে পড়ানো থেকে জীবনচর্যা মিলেমিশে একটা আলাদা নান্দনিক ভাষার জন্ম দিয়েছে, যা সবাই বুঝবে না।”

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই করিডরেই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সময় কাটাতেন তিনি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই করিডরেই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সময় কাটাতেন তিনি।

দীর্ঘ শিক্ষক জীবনের ভার নানা ভাবে বহন করেছেন ‘স্যর’ নিজেও। ‘রক্তকরবী’র সব ক’টি ক্লাসের শেষে নিয়ম করে ছাত্র-ছাত্রীদের সবার হাতে তিনি তুলে দিতেন এক একটি সত্যিকারের রক্তকরবী। পুলিশের জিম্মায় নিহত নকশাল, প্রিয় ছাত্র তিমিরবরণ সিংহের ‘ছিন্ন শির’ তিনি ময়দানের কৃষ্ণচূড়ায় দেখেছিলেন। আর জয়দেবের মৃত্যু তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়, ‘গঙ্গার পিঙ্গল জলে আজানু দাঁড়িয়ে আজ ছেলের তর্পণ করছে বাবা’! ‘নৈশ সংলাপ ২০০৭’ কবিতাটিতে জয়দেবের সঙ্গে সমসময় নিয়ে অসমাপ্ত কথার রেশ টেনে চলেছেন! কোনও সমান্তরাল বাস্তবতায় হয়তো আজও প্রিয় ছাত্রদের সঙ্গে ‘রিইউনিয়ন’-এই আজকের জটিল সময়কেও পড়তে চাইছেন পিতৃপ্রতিম এক কবি-শিক্ষক।

Sankha Ghosh

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।