রথের দিনে উৎসবের পোশাকে সেজে মানুষ ভিড় করেছে রাস্তায়। ছোট-বড় অসংখ্য রথ বেরিয়েছে। লাল সালু আর কাগজের পতাকার সঙ্গে রাংতা ও জরি দিয়ে সাজানো রথগুলির কয়েকটি দশ ফুট উঁচু তো কতকগুলো মাত্র ফুট দুয়েক। রথের ঠিক সামনে এক জোড়া ঘোড়ার মূর্তি আছে। তবে সেই রথ টেনে নিয়ে চলেছে নানা বয়সের ছেলেরা। রথের মধ্যে পুরীর দেবতার অনুকরণে তৈরি মূর্তির গায়ে সিল্কের পোশাক আর ঝুটো গয়না। সামনে স্তূপ করে রাখা ফুল। পূজারিরা সেই ফুল দেবতার আশীর্বাদ বলে বিক্রি করে। প্রতিটি রথের সঙ্গেই দেশি বাদ্যযন্ত্রে চূড়ান্ত শোরগোল তুলে চলছে এক দল বাজনদার।— শ্বেতাঙ্গ কলমে ফুটিয়ে তোলা কলকাতার রথযাত্রার এই রকমই বর্ণনা পাওয়া যায় এক আমেরিকান মহিলার লেখায়। মহাবিদ্রোহের পরের দশকে কলকাতায় মিশনারি হয়ে কাজ করতে এসে হ্যারিয়েট জি ব্রিটান এই উৎসবকে দেখেছিলেন এক ঔপনিবেশিক মিশনারির চোখেই। তাই বর্ণনার শেষে তির্যক মন্তব্য যোগ করে লিখেছেন, এদেশীয়রা মনে করে যে এটাই নাকি ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য আরাধনা।
অন্য দিকে, হিন্দু দেবতা ও ধর্মীয় আচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে শ্রীরামপুর মিশনের বিখ্যাত ত্রয়ীর অন্যতম উইলিয়াম ওয়ার্ড যত্ন করে লিখেছেন মাহেশের রথের কথা। তাঁর দেখা কাঠের রথের উচ্চতা ছিল তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট। চাকার সংখ্যা ষোলো। রথের সামনে ‘কোচম্যান’-সহ দু’টি ঘোড়ার মূর্তি। রথে চড়ে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম মিলে রাধাবল্লভের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সেখানে তাঁরা থাকেন আট দিন। সে সময় ভোগ তৈরির দায়িত্ব নেন অন্তঃপুরবাসিনী ব্রাহ্মণীরা। এই সময় রথটি ফাঁকা দাঁড়িয়ে থাকে। লোক জড়ো হয়ে রথের চার পাশে আঁকা দেবদেবীর ছবি দেখে। আট দিন বাদে দেবতারা নিজেদের মন্দিরে ফেরত যান। সাহেব লক্ষ করেছেন যে, রথযাত্রার তুলনায় এই পুনর্যাত্রা বা ফেরা যাত্রার উদ্যাপনে মানুষের উদ্দীপনার কিছু ঘাটতি থাকে। ঠিক রেসের মাঠের পাশের অস্থায়ী দোকানের সঙ্গে তুলনা করে ওয়ার্ড তার বর্ণনায় রথ উপলক্ষে দোকান বসার কথাও লিখেছেন। রথের মেলায় জুয়ার যারপরনাই জনপ্রিয়তা শুধু ওয়ার্ড নয়, সে কালের সমাচার দর্পণ পত্রিকারও চোখে পড়েছিল।
হুগলির কালেক্টর উইলিয়াম হার্শেল লিখেছিলেন, নিরাপদ খাবার, জল, থাকার জায়গার অভাবে সুস্থ-সবল মানুষ পুরীতে তীর্থ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, বা মারা যাচ্ছে। উনিশ শতক জুড়ে রথের সময় পুরীতে তীর্থ করতে যাওয়া যাত্রীদের স্বাস্থ্য নিয়ে বিচলিত হয়েছে প্রশাসন। পাশাপাশি, রথের সামনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জনের মতো কুপ্রথার কড়া নিন্দা করেছেন মিশনারিরা। এই সব নিয়েই ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রথযাত্রা উৎসব থেকে গিয়েছে তাঁদের লেখালিখিতে। ছবিতে পুরীর জগন্নাথ মন্দির নিয়ে ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বইয়ে রথযাত্রার ছবি, উইকিমিডিয়া কমনস থেকে।
শতবর্ষের সূচনা
১৯৫৬ সালে প্রথম নাটক সলিউশন এক্স, কিন্তু বাদল সরকার (ছবি) সর্বভারতীয় খ্যাতি পেলেন তার সাত বছর পরে লেখা এবং ইন্দ্রজিৎ-এর জন্য। বহুরূপী পত্রিকায় নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। ‘থার্ড থিয়েটার’-এর সূত্রে এক নতুন নাট্যধারা এল বাংলার নাট্যচর্চায়, তবু এ-ও সমান সত্য— বাদল সরকারকে মূলধারার বাংলা থিয়েটার-জগতের অবহেলা ও উপেক্ষাও কম সহ্য করতে হয়নি। ১৯২৫-এর ১৫ জুলাই জন্ম, এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষের সূচনা হতে চলেছে। তাঁর ও তাঁর নাট্যকৃতির স্মরণে গত বারো বছর ধরে অতি আদরে ‘বাদল মেলা’ আয়োজন করে আসছে নাট্যদল ‘গোত্রহীন’। এ বছর উৎসবে তাদের সঙ্গে আরও কয়েকটি নাট্যদল: অবশিষ্ট, ধুলা উড়ানিয়া, যাযাবর, ঝালাপালা, ফোর্থ বেল থিয়েটার, বোস থিয়েটার অ্যান্ড পারফর্মিং আর্ট। তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহে শুরু আজ, ১৫ জুলাই পর্যন্ত, রোজ সন্ধ্যা ৬টা থেকে। নাটকগুলি: ডালিয়া, পঞ্চকন্যা, নাইট মিরর, কমরেড কথা, লীলার বন্ধু, আড্ডা এবং ম্যাকবেথ।
প্রতিষ্ঠাদিবসে
“আমি চাই না আমার ঘরের চার দিক দিয়ে দেওয়াল ঘেরা হোক, আর আমার জানলাগুলো ঠাসা থাকুক। আমি চাই যতটা সম্ভব অবাধে আমার বাড়িতে সব দেশের সংস্কৃতি ফুটে উঠুক।” মহাত্মা গান্ধীর এই কথাই দিশারি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ফোরাম অব আর্ট অ্যান্ড কালচার (ইনফ্যাক)-এর। দেশে শিল্প ও সংস্কৃতির প্রচার ও উৎসাহ দিতে এই প্রতিষ্ঠানের শুরু ২০০৫ সালে, ২০১৬ থেকে প্রকাশ করে চলেছে ত্রিভাষিক বার্ষিক জার্নাল উইজ়ডম স্পিকস। ১৫ জুলাই তাদের ২০তম প্রতিষ্ঠাদিবস, সকাল ৯টায় ‘আর্ট হাইভ’-এ শিল্প শিবির, দেশ-বিদেশের তেইশ জন শিল্পীকে নিয়ে। সন্ধ্যায় আশুতোষ হল-এ পঞ্চকবিকে নিয়ে অনুষ্ঠান ‘হে চির নতুন’, বিশিষ্টজন-উপস্থিতিতে।
চেনা, অচেনা
ষাটের দশকে সোভিয়েট দেশে যখন অন্ধ দলতন্ত্রের অত্যাচারের লক্ষ্য হন সলঝেনিৎসিন, ‘রুশসাহিত্যের নবতম নক্ষত্র’-এর পক্ষে কলমে লড়ে গিয়েছিলেন সত্যপ্রিয় ঘোষ (১৯২৪-২০০৩)। পাণ্ডিত্যের পেশি-প্রদর্শনে অনীহা ছিল, ইতিহাসকে স্বচ্ছ ধারণায় দেখা তাঁর লেখনীর বৈশিষ্ট্য। সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা পত্রিকাকে দেন নতুন প্রতিষ্ঠা, সেই কাজে তাঁর অক্লান্ত শ্রম, গভীর গবেষণা তরুণ সম্পাদকদের উদাহরণীয়। তাঁর প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক সত্তা ঢাকা পড়ে গেছে কথাসাহিত্যের আলোয়: দেশভাগ, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার ধরা সেখানে। এ বছর ওঁর জন্মশতবর্ষ, ‘অহর্নিশ’ আয়োজিত ‘শতবর্ষে সত্যপ্রিয় ঘোষ’ অনুষ্ঠানে বলবেন প্রণব বিশ্বাস, রুশতী সেন ও নীলরতন সরকার। আজ মহাবোধি সোসাইটি সভাঘরে, বিকেল সাড়ে ৫টায়।
বোধিবৃক্ষ
নিজের পরিবেশ, সমাজ থেকেই সৃষ্টির উপাদান কুড়োন শিল্পী। তাঁর ভাবনায় ছায়া ফেলে পরিবেশের সঙ্কট, সমাজের টানাপড়েন। উন্নয়নের নামে আজ সবুজ ধ্বংস আর ভোগসর্বস্ব যাপনের ফল, বাড়তে থাকা বর্জ্যের পাহাড়। এর মধ্যে রয়েছে বিপুল বৈদ্যুতিন বর্জ্য, আমাদের অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভর জীবন যার উৎস। প্রাকৃতিক সবুজের জায়গা নিচ্ছে সার্কিট বোর্ডের সবুজ, প্রকৃত শুশ্রূষা কি পাওয়া যাবে তার কাছে? সঙ্কট ও তা থেকে উত্তরণের পথ ই-বর্জ্য দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী সনাতন দিন্দা, তৈরি করেছেন এ কালের বোধিবৃক্ষ, বহু যুগ আগে আর এক বোধিবৃক্ষ ও এক মহামানবকে মনে করায় যা। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে সনাতন দিন্দার একক ‘বোধি ট্রি’, আজ দুপুর ৩টেয় উদ্বোধন। ১৯ জুলাই পর্যন্ত, দুপুর ১টা-রাত ৮টা।
স্মৃতির আখর
হিমানীশ গোস্বামী, পি কে এস কুট্টি, গৌরীপ্রসাদ ঘোষ, সলিল বিশ্বাস, অমিত চৌধুরী, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, সমর বাগচি, অশোককুমার মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, স্থবির দাশগুপ্ত। “যাঁদের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে ছিল নানা পরতে পরতে... তাঁদের পথ চেয়ে আলংকারিক প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে কার না সাধ যায়?” ভূমিকায় লিখেছেন আশীষ লাহিড়ি। তবু জ্বলুক প্রদীপখানি বইটি আসলে উপরের দশ জনের প্রয়াণস্মরণিকা। লেখাগুলি বেরিয়েছিল নানা কাগজে, বিস্তর অদলবদলের পরে দু’মলাটে বাঁধা হয়েছে তাদের, ‘যতদূর সম্ভব ভাবালু না হয়ে’। আজ ১৩ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায় বিজয়গড় পল্লিশ্রী মোড়ের কাছে এডিএক্স স্টুডিয়োর দোতলার সভাঘরে বইটির প্রকাশ-অনুষ্ঠান, লেখক-সহ বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে। বইটির প্রকাশক ঋতাক্ষর, সান্ধ্য উদ্যোগটিও তাদেরই আয়োজনে।
আজও চমৎকার
“তাঁকে শুধু হাস্যরসাত্মক কিংবা কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ছাপ মেরে দিলে অত্যন্ত অন্যায় হবে। তাঁর বিরাট অভিনয়-জীবনে চরিত্রাভিনয়ই সবচেয়ে বেশি।” তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কে বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, “গৃহপ্রবেশ নামক একটি ছবিতে মাছওয়ালার চরিত্র করেছিলেন। কলকাতা শহরে যাঁরা মাছ বিক্রি করেন, তাঁদের কথাবার্তা উচ্চারণ বা ভাবভঙ্গি এত নিখুঁত ভাবে ফুটিয়েছিলেন, যা আমি আজও ভুলতে পারিনি।” বছর সাতেক আগে সৌমিত্রবাবুর এই দীর্ঘ বয়ানটি রেকর্ড করেন অরিজিৎ মৈত্র, তাঁর উদ্যোগেই তপন সিংহ ফাউন্ডেশন আয়োজিত তুলসী চক্রবর্তীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এটি দর্শক-শ্রোতাদের সামনে পেশ করা হবে, আগামী ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় গ্যালারি চারুবাসনা-য়। কথারম্ভে যোগেন চৌধুরী। দেখানো হবে তুলসীবাবুকেই মুখ্য ভূমিকায় ভেবে যে ছবি তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়: পরশপাথর (ছবিতে তারই একটি দৃশ্য)।
মননের মিল
রবীন্দ্রনাথের রচনায় ফ্রানৎজ় কাফকার কোনও উল্লেখ নেই, কাফকার কথোপকথনে মেলে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে হালকা, কিঞ্চিৎ শ্লেষ্মাত্মক এক মন্তব্য। আপাত বিপরীতমনা ও যোগাযোগহীন এই দু’জনের শিল্পকৃতিতে তবু পাওয়া যায় কিছু অচর্চিত কিন্তু গভীর সাদৃশ্য, ভাবনার রসদ হতে পারে তা। সেই সাদৃশ্য কখনও চেতনা ও কল্পনার স্তরে, সমসময় ও সমাজ থেকে উঠে আসা কিছু কল্পসৃষ্টিতে, কখনও জীবনবোধের অস্থিরতায়, কখনও বা লিপিচিত্রের ব্যবহারে: ভাষার বাঁধন আলগা করে লিপিকে মুক্তি দিচ্ছেন দু’জনেই এক অনির্বচনীয় অর্থময়তায়। টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘সোমেন্দ্রনাথ বসু স্মারক বক্তৃতা’য় অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলবেন এই নিয়েই। আগামী ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায়, কালীঘাট পার্কে রবীন্দ্রচর্চা ভবনে। ছবিতে এ বছর কলকাতা বইমেলায় জার্মানির স্টল-অলঙ্করণে ফ্রানৎজ় কাফকার ছবি।
উত্তরাধিকার
গত এক দশকে এ দেশে আক্রান্ত অগুনতি সাংবাদিক। এঁদের অনেকেই বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতা যুঝে মানুষের কাছে প্রকৃত তথ্য ও সত্যকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন, হাতিয়ার করেছেন আন্তর্জাল, সমাজমাধ্যম, নানা ওয়েবসাইট। এই সাহসী সাংবাদিকতার মুখ হয়ে উঠেছিলেন গৌরী লঙ্কেশ। তাঁর উত্তরাধিকার, সাংবাদিকতার স্বাধীন স্বর যে এখনও বর্তমান, প্রমাণিত লোকসভা ভোটের ফলে। এই দেওয়াল লিখনের আভাস পেয়েছিলেন গোরক্ষপুরের সাংবাদিক মনোজ সিংহ। গ্রামে গঞ্জে, খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে সংবাদ সংগ্রহ করেন তিনি, স্থানীয় সাংবাদিকতায় গৌরী লঙ্কেশের কর্মধারার শরিক। আগামী কাল ১৪ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায় সুজাতা সদনে পিপল’স ফিল্ম কালেক্টিভ-এর উদ্যোগে ‘রিপোর্টিং দ্য রিপাবলিক’ অনুষ্ঠানে মনোজ বলবেন ওঁর অভিজ্ঞতা। দেখানো হবে গৌরীর বোন, সমাজকর্মী চিত্রনির্মাতা কবিতা লঙ্কেশের তথ্যচিত্র— গৌরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy