সঙ্গী: যুগলে ২২ বছর ধরে পথ চলার উদ্যাপন সন্তু ও কবিতা পাঠকের। শনিবার, বারুইপুরে। নিজস্ব চিত্র
আষাঢ়ের এক বৃষ্টির রাত। সন্ধ্যা সাতটার লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল থেমেছে দক্ষিণ বারাসত স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে বৃষ্টি মাথায় আলো-আঁধারি পথে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক যুবক। আচমকা একটি রিকশা এসে তাঁকে পিছন থেকে ধাক্কা মারে। কাদা মাখা রাস্তায় ছিটকে পড়ে যান যুবক। একাই কোনও রকমে উঠছিলেন তিনি। অন্ধকারে একটি হাতের স্পর্শ। সে দিন তাঁকে টেনে তুলেই প্রশ্নটা ছিল, ‘‘লাগেনি তো? হাঁটতে পারবেন?’’
২২ বছর আগে বর্ষার সেই দিনটির কথা বলতে গিয়ে জন্মান্ধ সন্তু পাঠক বলেন, “স্ত্রী কবিতার সঙ্গে আলাপ হওয়াটা সত্যিই সিনেমার মতো। সাধারণত আমি আটটার ট্রেনে বাড়ি ফিরতাম। ওই দিন তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গিয়েছিল বলে সন্ধ্যা সাতটার লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে ফিরেছিলাম। যদি না সে দিন ওই ট্রেনে ফিরতাম, আর রিকশাটা ধাক্কা না মারত, তা হলে ওর সঙ্গে দেখাই হত না।”
শহরের রাস্তায় তাঁকে হাত ধরে পার করিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু সে দিন কবিতা তাঁকে হাত ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। সে দিন চলার পথে সন্তুর খোঁজ নিয়েছিলেন তরুণী। কী কাজ করেন যুবক, দৃষ্টিহীন হওয়ায় তাঁর হাঁটতে, ট্রেনে উঠে কোথাও যেতে অসুবিধা হয় কি না, এই সব আর কী। বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথে কথাও দেন তরুণী, ‘‘আবার দেখা হবে।’’
যা শুনে সন্তু বলেছিলেন, “আপনাকে দেখতে পাব না ঠিকই, তবু চিনে নেব।”
কী ভাবে চিনতেন? সন্তু বলেন, “সে দিন থেকেই ওর কণ্ঠস্বর মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল। ভিড় আর কোলাহলের মধ্যেও আলাদা করে ফেলতে পারব।” আর কবিতার? লাজুক হেসে কবিতা বলেন, “ওকে দেখতে খুব ভাল ছিল। সুদর্শন চেহারাটাই প্রথম দিন মনে থেকে গিয়েছিল।”
একসঙ্গে প্রথম হাঁটার আলাপে সন্তু জানতে পারেন, সকাল সাতটার লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে চেপে কবিতা কলকাতায় কাজে যান। ওই স্বরের আকর্ষণেই পর পর কয়েক দিন সেই ট্রেন ধরেন সন্তু। এক দিন দক্ষিণ বারাসত স্টেশনে ফের শুনতে পেলেন সেই স্বর। “কেমন আছেন?”
সেই শুরু। এর পরে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে পাশাপশি বসে যাওয়া। যুগলের মনে হত, এই ট্রেনের পথ যেন শেষ না হয়। সন্তুর কথায়, “কথা বলে একে অপরকে চিনলাম। বুঝলাম, অন্ধ বলে আমাকে সহানুভূতি দেখাচ্ছে না কবিতা।”
কবিতারও স্পষ্ট মনে পড়ে ২২ বছর আগের প্রথম আলাপের দিনগুলির কথা। “অনেকেই ভেবেছিলেন আমাদের জুটি হয়তো টিকবে না। বন্ধুরা বলেছিল দৃষ্টিহীনের সঙ্গে সংসার করা সহজ কথা নয়। পদে পদে বাধা আসবে। তা ছাড়া, ওর বাড়ি থেকেও বিয়েতে অমত ছিল। কিন্তু মনের মিল থাকায় কোনও বাধাই টেকেনি।”
বারুইপুরে টিনের চালা আর পাকা দেওয়ালের ঘরে সন্তু ও কবিতার দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার। ইমিটেশনের গয়না বিক্রি করেন কবিতা। স্ত্রী কাজে বেরোনোর আগে রান্নার কাজটা সন্তুই অনেকটা করে দেন। সন্তু বলেন, “ওর কাছে আনাজ কাটা শিখেছি। খুন্তি নাড়তে শিখেছি। এমনকি, ওর প্রিয় পায়েসও এখন রান্না করতে পারি।” পাশ থেকে কবিতা বলে ওঠেন, “আমি ওর কাছে গান শিখেছি।” নাটকের দলে তবলা, খোল বাজান সন্তু। দরকারে গানও করেন। সন্তু আর কবিতার সহজ স্বীকারোক্তি, “দু’জনের উপার্জন মাসে মেরেকেটে দশ হাজার টাকা। সংসারে টানাটানি তাই নিত্যদিন। তবু ভালবাসার অভাব হয়নি এ সংসারে। অথচ ঘরের জানলা খোলাই আছে। তাই কখনও দমবন্ধ লাগে না।”
প্রেম দিবসের উদ্যাপন এ সংসারে আলাদা করে করাই বাহুল্য। তবু স্ত্রীর জন্য সন্তু নিজের হাতে আজ, বানিয়ে দেবেন পায়েস। সন্তুর মতে, “ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলে আলাদা কিছু নয়। ওর ভাল লাগে বলে মাঝেমধ্যেই পায়েস বানাই। যে দিন পায়েস রান্না হয়, সে দিনই ভালবাসার উৎসব।” পাশ থেকে কবিতা বলে ওঠেন, “জানেন, কোনও কারণ ছাড়াই আমরা মাঝেমধ্যে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালেও উঠে পড়ি।”
তবে যে শোনা যায়, ফিকে হয়ে যাচ্ছে ভালবাসার রং! যান্ত্রিক জীবনে নিপাট ভালবাসার এমন গাথায় জুড়ে থাক অনেক লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy