Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Kolkatar Korcha

কলকাতার কড়চা: হেমন্তবিশ্বে শতবর্ষ পালন

দক্ষিণ কলকাতায় তাঁর বাড়ির অদূরে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে তিনি। পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জমূর্তিটি তৈরি করেছিলেন ভাস্কর সুরজিত দাস।

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২০ ০৭:৩৩
Share: Save:

আইকনের জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন কী ভাবে করা যায়, দেখিয়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ। সেই মাত্রায় হয়তো হত না হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (১৯২০-১৯৮৯) জন্মশতবর্ষের উদ্‌যাপন, কিন্তু বড় মাপেই যে হত সন্দেহ নেই। দশকের পর দশক মানুষ হেমন্তকে কান পেতে শুনেছেন। কিন্তু কতটা শুনবে আগামী পৃথিবী? কতটা শুনছে এ সময়? হয়তো শতবর্ষের সূত্রে নবজোয়ারে ফিরত বাঙালি শ্রুতির সেই পৃথিবী, রুপোলি পর্দার মায়াসভ্যতা, রবীন্দ্রগানের সেই আচমনবিশ্ব। ভাবনা ছিল ঘটা করে জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনেরই। স্বপ্ন সাকার হল না, কারণ প্রাণঘাতী সংক্রমণ গান বোঝে না। ১৬ জুন থমকে রইল করোনায়।

দক্ষিণ কলকাতায় তাঁর বাড়ির অদূরে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে তিনি। পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জমূর্তিটি তৈরি করেছিলেন ভাস্কর সুরজিত দাস। গাছগাছালিতে ঢাকা সে মূর্তি অধিকাংশ সময় পক্ষীপুরীষলাঞ্ছিত থাকত। বেদিটি উঁচু হওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যাও ছিল। শতবর্ষ উদ্‌যাপনের আগে কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে বেদির উচ্চতা কমানো হয়। ঝকঝকে করে তোলা হয় মূর্তিটিকে। শতবর্ষে পদার্পণের দিন মূর্তিতে মালা দিয়েছিলেন হৈমন্তী শুক্ল, শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতী হোমচৌধুরী, সৈকত মিত্র, ইন্দ্রনীল সেনরা। শতবর্ষ পূর্তির দিনও তাঁদের অনেকেই মালা দিলেন, গান গাইলেন। কিন্তু বিষণ্ণ হয়েই। কারণ, এমন নমিত উদ্‌যাপনের কথা ছিল না। ‘অ্যাসোশিয়েশন অব প্রোফেশনাল পারফর্মিং সিঙ্গার্স’ পরিকল্পনা করেছিল বছরভর রাজ্যের সব জেলায় আর কলকাতায় বড় মাপের স্মরণানুষ্ঠানের। কিন্তু করোনা-নীতি মেনে মূর্তির পাদদেশ জনা পনেরো জড়ো হয়ে ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ গাওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠল না। বহু সংস্থার ভাবনাই বাস্তবে অনূদিত হল না। থমকে রইল অংশুমান ভৌমিকের গ্রন্থ ‘হেমন্তসঙ্গীত’-এর প্রকাশ। থমকে গিয়েছে হেমন্ত-স্মরণে অ্যালবামও।

উপচার উপচে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। ফেসবুকে কবীর সুমনের ‘লাইভ’ আয়োজন নিবেদিত ছিল হেমন্তে। শুধু হেমন্তের গানই নয়, ফেলে আসা সময়ের ইতিহাসও উঠে এসেছিল তাঁর স্মৃতিচারণে। রেডিয়ো কোয়রান্টিন মুখর ছিল ঊর্মিমালা বসু, কাজি কামাল নাসের, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, সংবিদা লাহিড়ী, তন্ময় ভট্টাচার্য, শিমুল সেন, সোমনাথ শর্মা প্রমুখের হেমন্তিকায়। সুমিত দাসের প্রশংসনীয় ভাবনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামের নস্টালজিয়া নানা রঙে ধরা দিল। কলকাতা, মুম্বই-সহ নানা জায়গার হেমন্ত ফ্যান ক্লাব অনলাইন প্রযুক্তিই বেছে নিয়েছে উদ্‌যাপনে। সমাজমাধ্যমে ভেসে বেড়িয়েছে ধুতি-শার্টের চেনা বাঙালিয়ানা। বিচ্ছিন্ন কিছু অনুষ্ঠানও হয়েছে সামাজিক দূরত্ব মেনে। মেদিনীপুরে হায়দার আলির উদ্যোগে ‘রবীন্দ্রনিলয়’ ক্যাম্পাসে স্থাপিত হয়েছে শিল্পী সুবীর বিশ্বাসের তৈরি স্লেট-খোদাই হেমন্তমূর্তি।

হেমন্ত-অনুরাগীরা অপেক্ষা করছেন করোনা-কাল কেটে যাওয়ার। ভেবে রাখা সব পরিকল্পনাই রূপায়িত করতে চান শিবাজী চট্টোপাধ্যায়রা। লোপামুদ্রা মিত্রের ইচ্ছা, হেমন্তের গাওয়া কবিতার গান ও গণগান নিয়ে কাজ করার। আরও অনেকেরই রয়েছে নানা পরিকল্পনা। করোনার শাপমোচন না-ঘটা অবধি পূর্ণাঙ্গ উদ্‌যাপনের পায়ে বেড়ি। ছবি: পরিমল গোস্বামী

কলকাতার বাঙাল

নিজেকে বলতেন উভচর। তাঁর দুই পা ছিল বাংলার দুই চরে। দুই-ই তাঁর স্বদেশ। আসল বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুর, বেড়ে ওঠা উত্তর ও মধ্য কলকাতায়। ৪ জুলাই, কলকাতার কালিন্দীর বাড়িতে প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গবেষক অরুণ সেন। ১৯৩৬ সালের ২৪ নভেম্বর মালদায় জন্ম। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, অধ্যাপনা করেছেন জয়পুরিয়া কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘সাহিত্যপত্র’, ‘পরিচয়’, ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, ছিলেন সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলীয় উপদেশক পর্ষদের সদস্য। প্রবন্ধ রচনার জন্য বাংলা আকাদেমি থেকে বিদ্যাসাগর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তবে এ সব কিছুই ছাপিয়ে উঠে আসবে তাঁর বিষ্ণু দে চর্চার কথা। অরুণ সেনের মতো করে এ বিষয় নিয়ে আর কেউ ভাবেননি, গবেষণা করেননি। বিষ্ণু দে-কে নিয়ে তাঁর একাধিক গবেষণা গ্রন্থ বঙ্গবিদ্যাচর্চার আকর হয়ে রয়েছে। আর এক আগ্রহের বিষয় ছিল বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা। সেই বিষয়েও একাধিক বই লিখেছেন। ভালবাসতেন মানুষ। মানুষ চিনতে ভ্রমণ করতেন। সেই ছোঁয়া কিছুটা পাওয়া যায় জীবনের উপান্তে রচিত আত্মজীবনী কলকাতার বাঙাল: উভচর স্মৃতি বইয়ে। সেটাই আসল অরুণ সেন।

বই চলল

লকডাউনের শুরুতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় ছিল না বই। ছটফট করছিলেন পাঠককুল। আমপান কলেজ স্ট্রিটের ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দিল। ঠিক তখনই বই খুঁজে নিল পাঠকের ঠিকানা। ব্যস্ততা বেড়েছে বইঘর ডট ইন, বুকিকার্ট ডটকম, হারিতবুকস ডট কম-এর মতো বাংলা বই বিক্রির ওয়েবসাইটের। দু’-তিন বছর ধরে তাদের সৌজন্যে সারা দেশে বাংলা বই ও পত্রপত্রিকা পৌঁছে যাচ্ছে। আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের পাশেও তারা। বইঘর ডট ইন ও ‘বোধশব্দ’-এর যৌথ উদ্যোগ ‘বই মরে না!’— বৃষ্টির জলে ভেজা কিছু বই স্মারক হিসেবে কেনার আহ্বান। পাঠকের বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে বই, বাড়তি পাওনা শিল্পী শৈবাল মুখোপাধ্যায় ও সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি সুদৃশ্য বুকমার্ক, বইপাড়ার ঘুরে দাঁড়ানোর স্মারক। ‘গুরুচণ্ডা৯’-র পক্ষ থেকে শহরের নানা প্রান্তে বই পৌঁছে দিচ্ছেন এক দল উদ্যমী। অ্যাডভেঞ্চার সাইক্লিস্ট অর্ঘ্য মণ্ডলের সহযোগিতায় দলে রন্তিদেব রায়, দ্বৈপায়ন সেন, ঋজিক মুখোপাধ্যায়, নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়রা। বই বইছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে, পরিবেশ রক্ষায় ব্যবহার করছেন সাইকেল। করোনায় কোণঠাসা বই-জগতের মানুষগুলোকে স্বস্তি দিচ্ছেন, মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন পাঠকের। গত ত্রিশ বছর ধরে কলকাতার বইপ্রেমীদের প্রিয় তরুণ কুমার সাউ করোনা-আমপানের দিনগুলোতেও ত্রাতা। ফোন করলেই হল, তাঁর দু’চাকায় চড়ে দরজায় কড়া নাড়বে প্রিয় বই।

পড়াবন্দি

যে প্রত্যন্ত কোণ এখনও ইন্টারনেটের ছোঁয়া পায়নি, তাকে বাদ রেখেই অনলাইন পড়াশোনায় একটু অস্বস্তিকর রকমের অভ্যস্ত হয়ে উঠছে শহর। সকাল থেকেই গোটা বাড়ির উদ্বেগ, বাচ্চাকে সময়মতো অনলাইন ক্লাসে বসাতে হবে। বিদেশে নাকি ইস্কুল থেকেই ট্যাব দিয়ে যাচ্ছে, এখানে ঘরে ল্যাপটপ দূরস্থান, স্মার্টফোন আছে কি না সন্দেহ। শিশুটির ক্লাস শেষে তবে মা বা বাবা ওয়র্ক ফ্রম হোম-এ বসবেন। এ দিকে হোয়াটসঅ্যাপে অভিভাবক-গ্রুপে ঝড়, এই লকডাউনেও স্কুল অত টাকা চায় কী করে! সেশন ফি, স্টেশনারির খরচা, কার পুলের টাকা কমবে না কেন? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চুটিয়ে ‘ওয়েবিনার’ করছে। তার পরেও ফেসবুকে দীর্ঘশ্বাস, কবে ক্যাম্পাসে ফিরব? দুপুরের রোদ পড়ে এলে চাকরির পরীক্ষার পড়ায় মুখ গুঁজে থাকা তরুণ এসে দাঁড়ায় শহুরে মেসের বারান্দায়। গলিপথে দু-একটি খুদে ঝুঁটি টিউশনি সেরে ফেরে, স্যরের বাড়িতে এক বেঞ্চির দু’ধারে দুজন, মাস্ক সর্বক্ষণ। করোনা মাথায় থাক, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়লে চলবে না।

ছবির উৎসব

কোয়রান্টিন বা লকডাউনে কান, বার্লিন, ভেনিস, টরন্টো-র মতো চলচ্চিত্র উৎসবগুলো হাত মিলিয়ে গড়েছিল সম্মিলিত পরিসর ‘উই আর ওয়ান’ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ইউটিউবে একগুচ্ছ ছোট-বড় ছবি আর পরিচালকদের মাস্টারক্লাস দেখেছিলেন বিশ্ব জুড়ে ছবিপ্রেমী দর্শকরা। ঘরের কাছে কলকাতাও পিছিয়ে নেই। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া-র (এফএফএসআই) পূর্বাঞ্চল শাখা আয়োজিত অনলাইন চলচ্চিত্র উৎসবের ছ’টি পর্ব এরই মধ্যে হয়ে গিয়েছে। এক-এক সপ্তাহ জুড়ে এক-একটি পর্বে ছোট ছবি, তথ্যচিত্র, কাহিনিচিত্রের জমজমাট সম্ভার। ছিল কেরলের সতীশ ও সন্তোষ বাবুসেনান ভাইদের বহুচর্চিত মালয়ালম কাহিনিচিত্র ‘ইরুত্তু’, কাশ্মীরের মেয়েদের জীবনে নেমে আসা দুঃসহ নীরবতা নিয়ে বারামুলার শিক্ষিকা আসিয়া জ়াহুরের বানানো ছোট ছবি ‘দ্য স্টিচ’, দেশভাগের সত্তর বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের তানভীর মোকাম্মেলের প্রামাণ্যচিত্র ‘সীমান্তরেখা’ বা সেঁজুতি সুবর্ণা টুসি-র ‘মীনালাপ’, এ ছাড়াও অতনু ঘোষের ‘রূপকথা নয়’, শৈবাল মিত্রের ‘চিত্রকর’-সহ বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ওড়িয়া তথ্যচিত্র ও ছোট ছবি, এমনকি মাত্র হাজার পাঁচেক মানুষের মাতৃভাষা পাংচেনপা-য় তৈরি জাতীয় পুরস্কারজয়ী কাহিনিচিত্র, শ্রীলঙ্কা ও প্যালেস্টাইনের ফিচার ছবিও। সপ্তম পর্ব শুরু হচ্ছে আজ থেকে। টিকিটের ব্যাপার নেই, এফএফএসআই-এর ফেসবুক পেজে দেওয়া লিংক ক্লিক করলেই দেখা যাবে সব পর্বের ছবি।

পরিচয়ের দেবেশ

‘তবু একজন ছিল এই ধুলাশহরে আরুণি/ সে আমাকে বলে গিয়েছিল আল বেঁধে দেবে সে শরীরে।’ শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আরুণি উদ্দালক’ কবিতাটির সৃষ্টিমুহূর্তের কথা বলতে ফিরে যান ১৯৬৮-র জলপাইগুড়ির বন্যার স্মৃতিতে, ত্রাণ নিয়ে তর্কাতর্কিতে দেবেশ রায় মিলিটারির বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন “মারুন এইখানে, যদি সাহস থাকে।” আরুণির গল্পটা মনে পড়ে গিয়েছিল কবির, যা ক’দিন পরেই জন্ম দেয় তাঁর ওই কবিতাটির, “দেবেশই সেদিন এনে দিয়েছিল ধুলাশহরে আরুণির ছবি।” লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ ‘দেবেশকে নিয়ে ব্যক্তিগত’ গদ্যে, সম্প্রতি পরিচয় পত্রিকার অনলাইন ‘দেবেশ রায় স্মরণ সংখ্যা’য়, তাঁর গদ্যের প্রথম বাক্যটিই হল: “আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়”। সম্পাদকের নিবেদন-এও মন্তব্য করা হয়েছে “দেবেশ রায়কে আমরা কোন্ অভিধায় অভিহিত করব— ‘পরিচয়দ্যুতি’?” বাংলা গল্প-উপন্যাসের অতিনির্দিষ্টতার ছক ভেঙে দুর্গম সব খাত খনন করে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত থেকে বরিশালের যোগেন মণ্ডল-এ পৌঁছনো ও উপনিবেশের বাংলায় জন্মানো দেবেশ রায় (১৯৩৬-২০২০) সম্পাদক-সমালোচক-প্রাবন্ধিক হিসেবেও ছিলেন অস্তিত্বের শিকড়-খোঁজা বাংলা গদ্যের এক প্রধান চিন্তক। তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টির বিভিন্ন দিক নিয়ে স্মরণ-সংখ্যাটিতে লিখেছেন বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য, সৌরীন ভট্টাচার্য, সুভাষ ভট্টাচার্য, অমিতাভ গুপ্ত, সাধন চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল ঘোষ, অমর মিত্র, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, রুশতী সেন, স্বপন পাণ্ডা অভ্র ঘোষ, পার্থপ্রতিম কুণ্ডু। পরে স্বাভাবিকতা এলে এ-সংখ্যার সূত্রে বিশদে ‘দেবেশ রায় সংখ্যা’ মুদ্রিত করে প্রকাশ করবেন সম্পাদকমণ্ডলী।

দেরিদা ৯০

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের স্মৃতিচারণ, নাম-পরিচয় না জেনেই বই কেনার বরাত দিয়ে দেওয়া এক লেখক থেকে কী করে মানুষটা হয়ে উঠেছিলেন ‘পুরনো বন্ধু’। বিপ্লব মাজী পড়লেন মুক্ত মার্ক্সবাদের সঙ্গে তাঁর বিনির্মাণ তত্ত্বের সংযোগ নিয়ে প্রবন্ধ-ভাষণ। পবিত্র সরকার জানালেন, কেমন করে অর্থকে তন্নতন্ন করে খুঁজে খুঁড়ে দেখার প্রক্রিয়া জারি রাখে বিনির্মাণ, সমালোচকের তৃপ্তি বা সন্তুষ্টিকে আঘাত করে ক্রমাগত। ‘দেরিদার ভূত ও অধিবিদ্যার ছেরাদ্দ’ শিরোনামে দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তাঁকে বুঝতে হলে পাশ্চাত্য দর্শনের সমগ্র প্রেক্ষিতটা জানা প্রয়োজন। অভিজিৎ চৌধুরীর প্রশ্ন: তত্ত্ব আগে, সৃষ্টি পরে— তা কেন? তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনাকী দে, রিমি মুৎসুদ্দি, সম্রাট সেনগুপ্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ও একত্র স্বরে কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে ফুটে উঠল যে পূর্ণ অবয়ব, তাঁর নাম জাক দেরিদা। তাঁর ৯০তম জন্মদিন উদ্‌যাপন হল ঋক প্রকাশনীর ফেসবুক পেজে।

সময়ের ভাষ্য

‘করোনা-কারাঁটীন-লকডাউন নামক ঘটমান বর্তমানের সঙ্গে ইতিহাসের যোগাযোগ রচনা’ করার সুনির্দিষ্ট তাগিদে ‘অহর্নিশ’ পত্রিকা তাদের সদ্যপ্রকাশিত অনলাইন সঙ্কলনে প্রশ্ন তুলেছে: ‘‘কেন ‘পরিযায়ী’ বলব, কেন চিকিৎসাহীন থাকব, কেন পেশাহীন হয়ে যাব, কেন খেতে পাব না?’’ সঙ্কলনটির উপলক্ষ ‘উত্তরপাড়া জীবনস্মৃতি’র অরিন্দম সাহা সরদারের লকডাউন-তথ্যচিত্র ‘ডিম=বোমা’, যেখানে ক্যামেরার ভাষ্যে তথাকথিত কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পুঁজিপন্থী চরিত্রের মুখোশটি টেনে খুলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। দেশের বাজেটে সামরিক খাতে খরচার সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের আকাশ-পাতাল অসাম্যের কী পরিণতি হতে পারে, তাও দেখানো হয়েছে এই মহামারি-ফিল্মে। ছাব্বিশ মিনিটের ছবিটি ঘিরেই ‘অহর্নিশ’ (সম্পা: শুভাশিস চক্রবর্তী) সাজিয়েছে তাদের পিডিএফ-সঙ্কলন। সৌরীন ভট্টাচার্য, হিরণ মিত্র, শুভেন্দু দাশগুপ্ত, মীরাতুন নাহার-এর পাশাপাশি চিকিৎসাশাস্ত্রীয় প্রেক্ষাপটে কলম ধরেছেন স্থবির দাশগুপ্ত, শ্যামল চক্রবর্তী, তমোনাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ। সঙ্কলনটি উৎসর্গ করা হয়েছে দ্বিশতবর্ষী দুই বিজ্ঞানপ্রাণ সমাজচিন্তক অক্ষয়কুমার দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে; সেখানে সম্পাদক ‘করোনা বিতাড়ণে যজ্ঞকারী সমাজ’কে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন: এই দুই মনীষী উনিশ শতকে যুক্তিবাদের ‘যে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন, আমরা আধুনিকতার নামে তার আলোটুকু না নিয়ে শুধুই নিজেদের পুড়িয়েছি!’

খবরে কোভিড

লড়তে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেই। তবু আধুনিক রণাঙ্গনে ‘এমবেডেড’ সাংবাদিকদের থেকেও খানিকটা আলাদা লড়াই। সাংবাদিকতার চিরকেলে শর্ত খবর করা, কিন্তু এ বার যোগ হয়েছে নিজের পাশাপাশি অন্যকে বাঁচানোর শর্তও। মাথায় রাখতে হচ্ছে, ঝুঁকি যেন হঠকারিতা না হয়। সাংবাদিকের সামান্য অপরিণামদর্শিতা তাঁর পরিজন বা সহকর্মীদের জীবন বিপন্ন করতে পারে বুঝেই জরুরি সাবধানী পদক্ষেপ। সাংবাদিকের নানা অভিজ্ঞতার গল্পের মতো উঠে এল সপ্তাহান্তে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজ়ম ও মাস কমিউনিকেশন বিভাগের দু’দিনের ওয়েবিনার ‘কভারিং কোভিড-১৯ ইন সাউথ এশিয়া’র আসরে। আনন্দবাজার পত্রিকা, ওয়াশিংটন পোস্টের দিল্লি প্রতিনিধি, কাবুল-কাঠমান্ডুর বিবিসি, মেল টুডে, ঢাকার ডেলি স্টার, ইসলামাবাদের ইন্দাস নিউজ় ছাড়াও কলম্বো, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দরাবাদের সাংবাদিক, মূলধারার সংবাদমাধ্যম থেকে ডিজিটাল পোর্টাল ও পডকাস্ট— নানা আঙ্গিকের সংবাদকর্মীরা কথা বলেছেন। পরিযায়ী শ্রমিক থেকে প্রান্তিক অশ্রুত স্বর বা বৈষম্যের শিকার সংখ্যালঘু শ্রেণির কথা কত দূর মেলে ধরতে পেরেছে সংবাদমাধ্যম, তার কাটাছেঁড়া করেছেন সাংবাদিকরাই। ‘‘সংবাদমাধ্যমের পারা, না-পারার গল্পে সময়ের একটা দলিল,’’ বললেন আলিয়ার বিভাগীয় প্রধান মহম্মদ রিয়াজ়।

মারীচ সংবাদ

সত্তর দশকের শুরুতে হাওড়ায় থাকাকালীন অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই মাঠে ‘রামযাত্রা’র আসর থেকে ছেলে লালকে বাড়ি নিয়ে আসতে হত, স্মৃতিতে ফিরছিলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, “ওখানকার শ্রমজীবী মানুষজন সারা দিনের খাটুনির পর রামযাত্রা করে আনন্দ পেতেন, নির্দিষ্ট কোনও স্ক্রিপ্ট থাকত না, টানা চলত, এক-এক দিন এক-এক পর্বের অভিনয়। সেখানেই একটি দৃশ্যে দেখেছিলাম: মারীচ রাবণের আদেশ অগ্রাহ্য করে বলছে ‘আমি রাবণের বেতনভোগী কর্মচারী নই’। ক্ষমতা আর তার পীড়ন-দমনের বিরুদ্ধে যেন জোর পেলাম ‘মারীচ সংবাদ’ লেখার, লোকজ আঙ্গিকে মঞ্চস্থ করার।” ১৯৭২-এর নভেম্বরে ‘চেতনা’ নাট্যগোষ্ঠীর জন্মের আগেই সেপ্টেম্বরে কোঅর্ডিনেশন কমিটির বার্ষিক অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ হলেও, বাল্মীকির অংশটুকু যোগ করে গোটা নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৭৩-এর ১৫ জানুয়ারি। গায়নে-অভিনয়ে বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী (ছবিতে) ও শিবশঙ্কর ঘোষ, আলোক-পরিকল্পনায় দীপক মুখোপাধ্যায় মাত করে দিতেন তখন দর্শকদের। অরুণবাবু নির্দেশিত এ-নাটকে তাঁর রচিত-সুরারোপিত ‘মেরিবাবার গান’ আজও প্রাসঙ্গিক। পাঁচ দশক ধরে অভিনীত এ-নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে গত বছরেও, সদ্য ডিজিটাল ফরম্যাটে মুক্তি পেল ‘মাই সিনেমাহল’ অ্যাপে। “নাটকটির মঞ্চরূপ ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছিল ১৯৮৩-তে, তা থেকেই নতুন প্রজন্মের জন্যে এই সংরক্ষণ-প্রয়াস।” জানালেন সুজন মুখোপাধ্যায়।

বিদায়

‘পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে আমাদের আয়ু/ এখন মৃত্যুর শব্দ শোনে দিনমান।’ জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন বড় বেশি সত্য মারিপীড়িত এই সময়ে। এক জন আনিসুজ্জামান, দেবেশ রায়, হরি বাসুদেবন বা অরুণ সেনের প্রয়াণ বলে যায়, বিপুলা বঙ্গপৃথিবীর মননের ঋদ্ধ বৃত্তটা ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ। লকডাউনের ক’দিন আগে চলে গিয়েছেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, এপ্রিল-অন্তে একই বন্ধনীর অন্য নামটাও— চুনী গোস্বামী। সাহিত্যের পরিসর হারাল নিমাই ভট্টাচার্য সুরজিৎ দাশগুপ্তকে, বিজ্ঞানবিশ্বকে বিদায় অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মা-বাবার কাছ থেকে গল্প শোনা আজকের কিশোরীটি ইউটিউবে অমিতাভ-মৌসুমীর ‘রিমঝিম গিরে সাওন’ বা বিদ্যা সিংহ-অমোল পালেকরের ‘না জানে কিঁউ’ গানে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করল মুম্বইয়ের বাঙালিয়ানার প্রতিনিধি বাসু চট্টোপাধ্যায়, বা ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’র তরুণ হাসির সন্তু মুখোপাধ্যায়কে। ফেসবুক উপচে উঠেছে ‘রুদালী’ বা ‘হিম্মতমাঈ’ নাটকের মঞ্চে উষা গঙ্গোপাধ্যায়কে মন ভরে দেখার স্মৃতিতে। তাপস পাল থেকে অরুণ গুহঠাকুরতা, অভিনয়জগৎ শোকদীর্ণ। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গানেই রয়ে যাবেন রঞ্জন ঘোষাল, ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বাংলাদেশের বিজয় ঘোষণায় কামাল লোহানী, তাঁর সাদা-কালো ছবির অন্তরে ধরে থাকা ইতিহাসে— নিমাই ঘোষ।

তোমার আমার

করোনার গ্রাস থেকে পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে স্থানে স্থানে করোনামাতার পূজার খবর দিগ্বিদিকে প্রচারিত। গৃহবন্দিদশার দীর্ঘশ্বাসে আকাশবাতাস মুখরিত। এই আবহে বেবাক হর্ষ ও স্ফূর্তির মন্ত্র নিয়ে সম্প্রতি ভিন্ন গোত্রের এক বঙ্গীয় উপাসকগোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ এবং ওয়েবিনার-দুনিয়ায় পদার্পণ। এঁরা মার্জার-উপাসক। নিঃশব্দ পদচারণায় অগ্রসর হওন এবং অঘটন সম্পাদনের ব্যুৎপত্তি এঁদের করায়ত্ত। নচেৎ জনমাধ্যমের প্রাচীরে ‘তোমার বেড়াল আমার বেড়াল’ শীর্ষক আলোচনাসভা বসিয়ে ফেলার উর্বর ভাবনাটি কার্যে পরিণত করতে পারতেন না। সগর্বে ঘোষণা করতে পারতেন না, ‘‘তুলতুলে নরম চারপেয়ে ছোট্ট একটি প্রাণী। সে কুকুরের মতো প্রভুভক্ত নয়, পাখির মতো সুন্দর শিস দিতে পারে না, বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বাস করলেও তার মন বাইরের দিকে কেবলই উড়ুউড়ু।’’ তবু তারই মন পাওয়ার সাধনা, সকল ভালবাসা নিয়ে তারই পানে ধাওয়া। বাংলা সাহিত্যে, লোকাচার ও প্রবাদ-প্রবচনে, চিত্রশিল্পে (ছবিতে যামিনী রায়ের আঁকা বেড়াল জুটি, এখন সান দিয়েগো মিউজ়িয়াম অব আর্ট-এ রক্ষিত), সিনেমায় এবং দৈনন্দিনতায় বেড়ালের যারপরনাই গুরুত্বের সাতকাহন বলা হল শনি-সন্ধ্যার বৈঠকী আড্ডায়। মার্জার-দেবদেবীরা প্রসন্ন না হয়ে পারেন!

কুড়ি টাকায়

দেড়শো বছর আগে দেশ-গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে মাথা গুঁজতে হত যাদের, তাদের কম পয়সায় পেট-ভরানো খাবার জোগাতে তৈরি হয়েছিল পাইস হোটেল। পরে সুলভে খাবার জোগাতে ভরসা ছিল ফুটপাতের দোকানগুলো। এখন তারা ঝাঁপ ফেলেছে। এ দিকে লকডাউন উঠতে প্রশ্নও উঠেছে, আধা-বেতন, সিকি-বেতনে যাঁরা কাজে ফিরলেন, তাঁরা খাবেন কী? একটা উত্তর মিলেছে যাদবপুরে। সেখানকার শ্রমজীবী ক্যান্টিন মাত্র কুড়ি টাকার বিনিময়ে ভাত-তরকারি-ডিমের প্যাকেট দিচ্ছে দৈনিক সাড়ে চারশো-পাঁচশো জনকে। পরিচারিকা থেকে সিকিয়োরিটি গার্ড, সকলেই সেই লাইনে। একশো দিন পার করল সিপিএম দলের উদ্যোগ। খাইয়েদাইয়ে মন জয় কলকাতার সাবেকি সংস্কৃতি, এ বার তা এল রাজনীতিতে। একশো দিন পার করল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও প্রাক্তনীদের ‘যাদবপুর কমিউন’-এর বিনামূল্যে খাবার বিতরণের উদ্যোগও। এখনও দিনে হাজারখানেক মানুষ রান্না-করা খাবার পাচ্ছেন। দুটো উদ্যোগই কাজ চালিয়ে যাবে, বাড়াবে কাজের পরিধিও— জানা যাচ্ছে।

মানুষের পাশে

কলকাতায় থাকার সময়ও বরাকের মানুষ ও তাঁদের সংগ্রাম নিয়ে ভাবতেন নীলোৎপল চৌধুরী (১৯৪৮-২০২০)। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ার সময়, বা পরে চাকরি জীবনেও বার বার উত্তর-পূর্বে ফিরতেন তিনি। আশির দশকে কলকাতার ডাকে ফিরে আসেন, ‘ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’-এর বৃহত্তম সহযোগী ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স ফেডারেশন’-এর কো-অর্ডিনেটর করা হয় তাঁকে। পদে থাকাকালীন বাগিচা শ্রমিকদের মধ্যে স্ত্রীশিক্ষা ও জীবনধারার মান উন্নয়নে প্রশিক্ষণ শিবির আয়োজন করেন। দাবিদাওয়া নিয়ে ইউনিয়ন মালিকপক্ষ ও সরকারের মধ্যে সমন্বয়েও ব্রতী হন। গুরুত্ব দিয়েছিলেন উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষত বরাক উপত্যকার রবার-চাষে। পরে অসমের সংবাদগোষ্ঠী ‘যুগশঙ্খ’-এর পরিচালন-সমিতিতে যুক্ত হন। মানুষের মন বোঝার জ্ঞানকে পত্রিকার কাজে লাগিয়েছিলেন। কর্মপ্রাণ মানুষটি সম্প্রতি চিরতরে ছেড়ে গেলেন প্রিয় বরাকভূমি।

কল্লোলিনী

আর পৃথিবীর পরে ওই নীলাকাশ, তুমি দেখেছ কি? অনেক দিন যাবৎ এ-প্রশ্ন শুনে কলকাতার মুখে ঘনিয়ে আসত অনিবার্য ধোঁয়াশা। কিন্তু ইদানীং নগরজীবন যেন সত্যিই অনেক রূপের রঙিন চয়ন। নীল আকাশ, সাদা মেঘ, প্রত্যুষে আর প্রদোষকালে আশ্চর্য রঙের খেলা— মুগ্ধ নাগরিক মন দিয়ে দেখেন, প্রাণ ভরে ছবি তোলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার অনন্ত অ্যালবামে ছড়িয়ে দেন সেই চিত্রমালা, অতি বড় অরসিকও সে-সব দেখে চমকে ওঠে, ‘‘আরে! এটা কলকাতা! দেখে তো একেবারে...’’ পরমুহূর্তেই অবশ্য বেরসিক মনে করিয়ে দেয়, সুন্দর মুখ দেখে ভুলো না, এই সব শোভা-টোভা অনেক মানুষের অনেক যন্ত্রণা আর অনাহারের মূল্যে কেনা। কল্লোলিনী তিলোত্তমা সব শোনে, মনেও নেয়, তার পরে মৃদু স্বরে বলে: দেখে নাও দুদিন বই তো নয়। ঠিকই, দেখতে দেখতেই রাস্তায় কত গাড়ি ফিরে এল। ধোঁয়াশাও শিগগিরই ফিরবে।

বল পায়ে মাঠে নামার ময়দানি স্বপ্ন

এক কালে কলকাতা ময়দানের প্রথম ডিভিশনে চুটিয়ে গোলকিপিং করতেন চয়ন দাস। বড় ক্লাবে সুযোগ মেলেনি, কলকাতা সংলগ্ন ছোট ছোট ক্লাবে গোলকিপার কোচ হিসেবে কাজ করে যতটুকু আয় হত, অতিমারি তা কেড়ে নিয়েছে। ফুটবল থেকে দূরে সন্দীপ হেমব্রম, রাকেশ দাস, নিরঞ্জন সাহার মতো অনেকেই। কলকাতা ময়দানে ফুটবল বন্ধ, বন্ধ জেলার ছোট টুর্নামেন্টও। করোনা-অতিমারির আগে এঁরা সকলেই বিভিন্ন ছোট ক্লাবে নিয়মিত খেলতেন।

অতিমারির কারণে বিশ্ব জুড়ে সমস্ত খেলার উপরেই কোপ। এরই মাঝে কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বড় খবর— মোহনবাগানের আটলেটিকো দ্য কলকাতা-র সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আইএসএল-এ প্রবেশ। কিন্তু কলকাতার ফুটবলের প্রধান সাপ্লাই লাইন জেলাভিত্তিক ছোট টুর্নামেন্ট ও ময়দানের প্রথম ডিভিশনের টুর্নামেন্টগুলো। গ্রাম-মফস্‌সলের উঠতি ফুটবলারদের বড় ক্লাবে সুযোগ পাওয়ার প্রথম ধাপ এগুলোই। অতিমারি যে সিঁড়িকে অনেকটাই নড়বড়ে করে দিয়েছে।

কলকাতা ময়দান ও জেলা ফুটবলের পরিচিত নাম মৃত্যুঞ্জয় দাস। উঠতি ফুটবলারদের আদরের ‘মিঠুদা’ জানালেন, ছোট ক্লাবগুলির বেশির ভাগ খেলোয়াড় আসেন গ্রাম থেকে। তাঁদের যাতায়াতের ভাড়া, টিফিন খরচা ও এককালীন কিছু অর্থমূল্য বহন করত ছোট ক্লাবগুলো। এগুলোর ব্যবস্থা হত ব্যক্তিগত স্পনসরের হাত ধরে। সমস্ত কিছুই এখন বন্ধ, কারণ খেলা বন্ধ। ফুটবলের মূল স্রোতে ফেরত আসাটাই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক খেলোয়াড়ই পেট চালাতে জমিতে ফসল কাটার কাজ বা মজুরের কাজ করছেন। কেউ পথের ধারে বসছেন আনাজ বা মাছ নিয়ে। স্থানীয় ক্লাব, মাঠ বন্ধ থাকায় প্র্যাকটিসও বিশ বাঁও জলে। কলকাতার ময়দানে বল পায়ে ফের মাঠে নামা তো অনেক দূরের স্বপ্ন। চলতি বছরের শেষ দিকে কোভিড-১৯’এর প্রকোপ কমে গেলেও, ময়দান তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এলেও সন্দীপ, রাকেশ, নিরঞ্জনদের মতো অনেকেরই বল পায়ে মাঠে নামা হবে না। প্রথম ডিভিশনের টুর্নামেন্টগুলি আয়োজন করাও সম্ভব হবে না। কারণ তখন মাঠগুলো সিএবি-র অধীনে চলে যাবে। শুরু হবে ক্রিকেটের মরশুম।

শুধু অস্থায়ী কোচ বা ছোট ক্লাবের ফুটবলাররাই নয়, সমস্যায় রয়েছেন মালিরাও। প্রধান ক্লাবগুলো ছাড়া বাকি ক্লাবের মালিদের মাসিক রোজগারের প্রধান উপায় ছিল ব্যক্তিগত স্পনসরের যৎসামান্য সাহায্য অথবা ফুটবলার-কোচদের চাঁদা তুলে জোগাড় করে দেওয়া অর্থ। ময়দানে যে সমস্ত ক্লাবের নিজেদের মাঠ বা গ্যালারি রয়েছে, সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণকারী মালিদের কথা আলাদা, কিন্তু ছোট ক্লাবের মালিরা খেলোয়াড়দের জার্সি কেচে দেওয়া বা প্র্যাকটিসের পরে সামান্য টিফিন তৈরি করার মতো কাজ করতেন। বিনিময়ে কিছু অর্থ মিলত। সে সমস্তই এখন বন্ধ। ফলে বিপদে তাঁদের পরিবারও।

ময়দানের ছোট মাঠগুলোয় ঘাসের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। মাঠের কোনায় গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। আঁধার ঘনাচ্ছে ফুটবলার ও অস্থায়ী কোচেদের জীবনেও। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy