দখল: দোকানে ভরেছে ফুটপাত। হাঁটার জায়গা উধাও। ছবি: রণজিৎ নন্দী, স্বাতী চক্রবর্তী
শুধু আশ্বাসই ভরসা!
বছরের পর বছর প্রশাসনের নানা স্তরে নানা আলাপ-আলোচনা হয়। কিন্তু কলকাতায় দখলদারির হকার-চিত্র বদলায় না! মেয়র পদে যিনিই থাকেন, অগ্নিকাণ্ড হলেই বলে দেন, ‘‘ফুটপাত আটকে হকারদের স্টল বরদাস্ত করা হবে না।’’ অথচ, উল্টোডাঙায় প্রায় গোটা ফুটপাত গ্রাস করে হকারদের জন্য লোহার স্থায়ী স্টল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
আসন্ন পুর নির্বাচনে দখলদারির এই হকার-রাজ কতটা প্রভাব ফেলে, সেটাই দেখার। ভোটের আগে শহর ঘুরে অবশ্য দেখা গেল, প্রায় কোথাওই কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফুটপাত তো বটেই, একাধিক রাস্তাও কার্যত হকারদের দখলে। ফলে, গাড়ির গতি শ্লথ হওয়ার পাশাপাশি অহরহ দুর্ঘটনাও ঘটছে। কলকাতা পুলিশ সূত্রেই খবর, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ৩২ হাজার পথ-দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী ফুটপাত ছেড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটা। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে (কিছুটা সময় লকডাউন ছিল) এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা আট হাজারের কাছাকাছি। পুলিশের বড় অংশেরই বক্তব্য, ‘‘বছরে যত পথ-দুর্ঘটনা ঘটে, তার এক-তৃতীয়াংশই হকারদের দাপটে ফুটপাত ছেড়ে পথচারীরা রাস্তায় নেমে আসায়। কিন্তু প্রশাসনের সব মহলের এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা নেই। উল্টে চলে মদত দেওয়া।’’
মদতের এই চিত্রই দেখা গিয়েছে উত্তর কলকাতার মুচিবাজারে। সেখানে হকারদের জন্য প্রায় গোটা
ফুটপাত জুড়ে তৈরি লোহার স্টলের উপরে একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীর পাশে স্থানীয় বিধায়ক, কাউন্সিলর ও বরো চেয়ারম্যানের ছবি। এক হকার বললেন, ‘‘যাঁরা স্টল দিয়েছেন, তাঁদের ছবি তো থাকবেই।’’ হাতিবাগানের অবস্থাও একই। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, আগে স্টলের উপরে প্লাস্টিক লাগানো থাকত। এখন পাকাপাকি বন্দোবস্ত হিসাবে কাপড় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ, এমন প্লাস্টিক বা কাপড়ের স্টলের জন্যই তো গত কয়েক বছরে একাধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। হকার রাজেশ সিংহ বললেন, ‘‘আগুন লেগে গেলে নতুন স্টল তৈরির টাকা পাই! তা ছাড়া, এখানকার দাদাদের সঙ্গে আমাদের সেটিং আছে। তাই হকারদের কেউ বাধা দেয় না।’’
অভিযোগ, এই কারণেই বড় অগ্নিকাণ্ডের পরেও মধ্য কলকাতার বাগড়ি মার্কেট বা দক্ষিণের গড়িয়াহাট বাজারে হকারদের ডালা-রাজ বন্ধ হয় না। গড়িয়াহাটে দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি লাগানো স্টল পেয়েছেন দুই ভাই ও তাঁদের মা। পরপর জুড়ে নেওয়ায় এখন তাঁদের স্টলই সব চেয়ে বড়। তাতে কী? পুরনো ডালার ব্যবসাও ছাড়তে পারেননি তাঁরা। বাগড়ি মার্কেটে আবার ডালা নিয়ে প্রশ্ন করায় শুনতে হল, ‘‘ডালা ছাড়া হকারি হয় না। হকার ছাড়া কলকাতা হয় না। আমাদের তোলা যায় না। ভোটের বালাইয়ে কোনও সরকারই আমাদের কিছু করতে পারে না।’’
যদিও হকার বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত, পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর বিদায়ী সদস্য দেবাশিস কুমার বললেন, ‘‘আমরা হকার-নীতি প্রণয়ন করে সার্টিফিকেট দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আইনি জটিলতায় তা করা যায়নি। তবে কোনও ফুটপাতেরই এক-তৃতীয়াংশের বেশি জায়গা জুড়ে হকার বসার কথা নয়।’’
পুরসভা সূত্রের খবর, কলকাতায় এই মুহূর্তে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ হকারির সঙ্গে যুক্ত। গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ, গোলপার্কে প্রায় আড়াই হাজার হকার আছেন। ২০১৪ সালে ‘পথ বিক্রেতা (জীবিকা সুরক্ষা ও পথ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ) আইন’ পাশ হয়। সেই আইনে শহরের আড়াই শতাংশ জনসংখ্যা হকারিতে থাকবে ধরে নিয়ে শহর পরিকল্পনা করতে বলা হয়। কিন্তু সেই ভাবে শহর পরিকল্পনা তো হয়ইনি, উল্টে ফুটপাত দখল করে এ ভাবে ব্যবসা চালাতে দিলে তা নাগরিকের অধিকারের পরিপন্থী কি না, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এই বিতর্কই চলছে কালীঘাট মন্দির চত্বর বা পুরসভার সদর দফতরের সামনে। ওই দুই জায়গাই এই মুহূর্তে হকারদের স্বর্গরাজ্য। ২০১৪ সালে নিউ মার্কেট চত্বর থেকে হকারদের সরানো নিয়ে জোর আলোচনা হয়। পুরসভার হিসাবে, ওই সময়ে বার্ট্রাম স্ট্রিট ও শ্রীরাম আর্কেডের সামনে প্রায় ২২৫ জন হকার ছিলেন। তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য রাস্তা মাপজোকও হয়। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এর পরে কোনও অজ্ঞাত কারণে ওই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। কালীঘাট নিয়েও একই ব্যাপার ঘটে।
ভোট বৈতরণী পার করতে সেই সব ধুলো পড়া ফাইল কি আদৌ পাশ হবে? নির্বাচনী পরম্পরা বলছে, সেই সুযোগ খুবই কম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy