বেহাত: বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে রাস্তায় বসেছে বাজার। ছবি: সুমন বল্লভ
গতি, ক্ষতি আর আতঙ্ক— বাসিন্দারা বলেন, তিনের সমাহারে বরো পাঁচ। কলকাতা পুর এলাকার যে বরো এগারোটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। যার পরিধি এক দিকে শিয়ালদহ স্টেশন। অন্য দিকে, স্ট্র্যান্ড রোড বরাবর গঙ্গাপাড়। মাঝে ডালহৌসি ও কলেজ স্ট্রিট। মধ্য কলকাতার পুরনো এই এলাকা মূলত ব্যবসায়িক অঞ্চল। তবে শিক্ষাঙ্গনও বটে। শহরের ভরকেন্দ্র শিয়ালদহ স্টেশনও এখানেই।
ওই স্টেশন ঘিরে চলা বিপুল কর্মকাণ্ডে সদাজাগ্রত শিয়ালদহ উড়ালপুল (পাথরে লেখা বিদ্যাপতি সেতু)। স্টেশনের গা ঘেঁষে গিয়েছে ব্যস্ত উড়ালপুলটি। যার নীচে আনাজের বড় পাইকারি বাজার কোলে মার্কেট। আছেন অগুনতি হকার আর জীবিকার খোঁজে আসা মানুষের খোলা আশ্রয়। রাস্তার ধারে মাছের পাইকারি বাজার। একটু দূরেই ফলের পাইকারি বাজার, মেছুয়াপট্টি। আশপাশের মানুষ বলেন, শিয়ালদহ স্টেশন সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কখনও রাত নামে না। গতির দৌড় আর কাজের হল্লা অবিরাম চলে।
আর আতঙ্ক? যার জন্য উড়ালপুলে উঠতে গিয়ে এক বার হলেও সিঁথির বাসিন্দা সুদীপ মিত্রের মনে পড়ে যায় মাঝেরহাট বা পোস্তার নির্মীয়মাণ সেতু ভাঙার কথা। সুদীপের দাবি, ‘‘মাঝেরহাট-কাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, শহরের ২০টি সেতু ও উড়ালপুলের মেয়াদ ফুরিয়েছে। তার মধ্যে বিদ্যাপতিও ছিল। অথচ এর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ছাড়া কিছুই তো চোখে পড়েনি।’’ উড়ালপুলের নীচের ব্যবসায়ীদের অধিকাংশের দাবি, নতুন করে তৈরি হোক সেটি। বছর তিনেক আগে শোনা গিয়েছিল, বর্তমান উড়ালপুলের উপরেই স্তম্ভের মাধ্যমে দ্বিগুণ উচ্চতার ছ’লেনের উড়ালপুল হবে। সেটি সম্পূর্ণ হলে পুরনোটি ভেঙে ফেলা হবে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।
উড়ালপুল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা, ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর সোমা চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, ‘‘বুড়িমা (পাঁচ নম্বর বরোর কোঅর্ডিনেটর অপরাজিতা দাশগুপ্ত) বেঁচে থাকতে শিয়ালদহ উড়ালপুল সংস্কারের কথা বার বার বলতেন। আমিও চাই ভাল করে সংস্কার হোক।’’ মাসকয়েক আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন অপরাজিতা দাশগুপ্ত। তাঁর এলাকা দেখাশোনা করছিলেন ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর রেহানা খাতুন। ওই বিদায়ী কোঅর্ডিনেটরের দাবি, ‘‘নতুন পুর বোর্ড এলে শিয়ালদহ উড়ালপুল ঢেলে সংস্কার করতে সরকারের কাছে দাবি জানাব।’’
সংস্কার বা উন্নয়ন, শব্দগুলো আজ আর হাসি ফোটায় না দুর্গা পিতুরি লেন, সেকরাপাড়া লেন, গৌর দে লেনের বাসিন্দাদের। আতঙ্ক আর ক্ষতি যেখানে গলা জড়াজড়ি করে থাকে, সেখানে তেমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। উন্নয়নের জোয়ার কী ভাবে তাসের ঘরের মতো আশ্রয় ভাসিয়ে নিতে পারে, তা ওই এলাকার বাসিন্দারা বুঝেছেন। ২০১৯ সালের ৩১ অগস্ট। মেট্রো প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে সে রাতে ধস নামে ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের ওই তিন পাড়ায়। বেশির ভাগ বাড়ি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। এমনই একটি বাড়ির বাসিন্দা আশিস সেন এখন আমহার্স্ট স্ট্রিটে ভাড়া থাকেন। তাঁর কথায়, ‘‘কবে নিজের পাড়ায় ফিরব জানি না।’’ ওই ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর সত্যেন্দ্রনাথ দে জানাচ্ছেন, দুর্গা পিতুরি লেন, সেকরাপাড়া লেন এবং গৌর দে লেনে বাড়ির পাশাপাশি বিপুল ক্ষতি হয়েছিল নিকাশি, জল সরবরাহ লাইন ও রাস্তার। এখনও পর্যন্ত একটি লেনের পরিকাঠামো মেরামত করা গিয়েছে। বাসিন্দাদের ফিরিয়ে আনাই মূল লক্ষ্য প্রশাসনের বলে দাবি তাঁর।
এই বরোর আর এক যন্ত্রণা দূষণ। কোলে মার্কেটের উল্টো দিকে শিয়ালদহের পাইকারি মাছ বাজারের দুর্দশা নিয়ে অভিযোগ বিস্তর। দুর্গন্ধে পাশ দিয়ে হাঁটাই দায়! বাসিন্দাদের দাবি, কোলে মার্কেটে ঢোকার মুখে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের দু’পাশের রাস্তা দখল হয়ে গিয়ে দিনদিন সঙ্কীর্ণ হচ্ছে। ঘন জনবসতির অঞ্চলে রয়েছে ধোঁয়া-দূষণ, শব্দদূষণ, দৃশ্যদূষণ। তিন বার আবর্জনা পরিষ্কার হলেও যত্রতত্র তা পড়েই থাকে বলে অভিযোগ।
বেসরকারি ওই মাছ বাজার দেখাশোনার দায়িত্ব স্থানীয় বাজার সমিতির। ‘পাইকারি মাছ বাজার সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক অধীর বিশ্বাসের দাবি, ‘‘সরকার না এগোলে ব্যবসায়ীদের পক্ষে বাজারের দূষণ ঠেকানো অসম্ভব।’’ মেছুয়ার ফলপট্টি নিয়েও অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের। ‘দ্য ক্যালকাটা ফ্রুট মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ ইফতেকার আলম বলেন, ‘‘একাধিক ফল বোঝাই গাড়ি ঢোকে। ধোঁয়ার দূষণ তো হবেই। আবর্জনাও পুরো পরিষ্কার হয় না। আমরা তো চাই এই পাইকারি ফলের বাজারকে শহর থেকে সরিয়ে নেওয়া হোক।’’ স্থানীয় ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর সগুফতা পরভিনের দাবি, ‘‘বাজারে নিয়মিত আবর্জনা পরিষ্কার হয়। তবে বাজার সরানোর বিষয়টি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মধ্যে পড়ে।’’
এই বরোর প্রতিনিধিদের দাবি, উন্নয়নের একাধিক কাজ হয়েছে। কিছু স্থায়ী সমস্যা কয়েক দশকেও মেটেনি। যার অন্যতম পার্কিং। ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেসের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর সন্তোষ পাঠকের মতে, পার্কিং নিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার।
বরোয় রয়েছে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল। পর পর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তৈরি শিক্ষাঙ্গন ঘিরে ঐতিহ্যের বইপাড়া। ফুটপাত জুড়ে বইয়ের দোকান, রাস্তার অনেকটা দখল করে থাকা সাইকেল ভ্যান, গাড়ি। সে সব কাটিয়ে হাঁটাচলা করাই মুশকিল। এক প্রকাশক বুলবুল ইসলামের অভিযোগ, ‘‘প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের বইয়ের স্টলগুলি বর্ণপরিচয় মার্কেটে স্থানান্তরিত করার কথা ছিল। আজও তা হল না।’’
তবে বইপ্রেমীরা বলেন, হাজার সমস্যা সত্ত্বেও বইপাড়া আছে বইপাড়াতেই। কত আন্দোলনের সাক্ষী এই ঐতিহ্য। তার কদর সরকারি প্রতিশ্রুতি আর লাল ফিতের বাঁধন আদৌ কি বুঝবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy