অসহায়: ভরা কটালের জেরে জল ঢুকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে জিনিসপত্র। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন এক মহিলা। বুধবার, পূজালি লঞ্চঘাটের কাছে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
ঠোঁটে চওড়া হাসি। চোখে-মুখে যেন যুদ্ধজয়ের স্বস্তি! বুধবার দুপুর সাড়ে তিনটেয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উল্টো দিকের ওষুধের দোকানের শাটার তুলে প্রবল উত্তেজিত দোকানমালিক বললেন, ‘‘এতক্ষণে শান্তি। এ বারের মতো ঝড়ের ফাঁড়া মনে হচ্ছে কেটে গিয়েছে। জরুরি সামগ্রী হলেও সকাল থেকে দোকান খোলার সাহসই দেখাতে পারছিলাম না!’’ পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তির মন্তব্য, ‘‘ওষুধ নিতে আসব কী, অসুস্থ বাবাকে ধরে ভয়ের প্রহর গুনছিলাম। এখন নিশ্চিন্ত।’’
স্বস্তির শ্বাস ফেলছেন প্রতাপাদিত্য রোডের রঙ্গন মিত্রও। সকাল ৯টা নাগাদ তাঁদের বাড়ির বারান্দার একাংশ নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল একটি গাছ। বেলা বাড়লে বিপদ আরও বাড়তে পারে, সেই আতঙ্ক কাটিয়ে বিকেলে রঙ্গনের মন্তব্য, ‘‘এত স্বচ্ছন্দে দিনটা যে কেটে যাবে ভাবিইনি। সকালে ওই ঘটনার পর থেকে উদ্বেগে যেন সময় কাটছিল না!’’
এ দিন সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াসের’ অপেক্ষায় উদ্বেগের এমন প্রহর কাটাচ্ছিলেন ঘরবন্দি শহরবাসী। ঝিরঝিরে বৃষ্টির সঙ্গে কয়েক দফা ঝোড়ো হাওয়া সেই উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েক গুণ। হঠাৎ ছড়িয়ে পড়া ‘খবরে’ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল টর্নেডোর মুখোমুখি হওয়ার ভয়। সেই ভয় ক্রমে স্বস্তিতে বদলে যেতে শুরু করে বেলা বাড়তেই। যেখানে যেটুকুও বৃষ্টির ছাপ ছিল, দুপুরের রোদে তা-ও এক সময়ে মিলিয়ে যায়। বিকেলের পরে কড়া বিধিনিষেধের আর পাঁচটা দিনেই কার্যত ফিরে যায় শহর। যথারীতি ট্র্যাফিক সিগন্যালে বেড়ে যায় গাড়ির ভিড়, খুলে যায় নানা জরুরি পরিষেবা সংস্থার দরজা। যা দেখে এক ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, ‘‘সকাল ৯টা-১০টায় শহরের চেহারার সঙ্গে বিকেলের এই কলকাতার মিল পাওয়াই মুশকিল।’’
এ দিন সকাল থেকে আক্ষরিক অর্থে জনশূন্য ছিল শহর। স্রেফ মোড়ে মোড়ে দেখা গিয়েছে পুলিশি এবং পুরসভার জরুরি ব্যবস্থাপনা। ফলে উল্টোডাঙা, খন্না, আর জি কর হাসপাতাল, নাগেরবাজার, সিঁথির মোড় হয়ে মধ্য কলকাতায় আসতে অন্য দিনের চেয়ে সময় লেগেছে অনেক কম। একই অবস্থা হাজরা, বালিগঞ্জ, যাদবপুর, হাইল্যান্ড পার্ক, পার্ক সার্কাস, রুবি হয়ে শহরের দক্ষিণ অংশেরও। কড়া বিধিনিষেধ সত্ত্বেও ভিড় না-কমার অভিযোগ ওঠা বড়বাজারও এ দিন ছিল শুনশান। ফাঁকা রাস্তায় দেখা গিয়েছে শুধু প্লাস্টিকে মোড়া ডালার সারি। এর মধ্যেই মাঝেমাঝে কয়েক পশলা বৃষ্টির সঙ্গে জল বাড়তে থাকে গঙ্গায়। বাজেকদমতলা, আহিরীটোলার মতো ঘাটগুলির সিঁড়ি সম্পূর্ণ ডুবে যায়, জল উঠে আসে প্রায় রাস্তা পর্যন্ত। হাওড়া সেতু থেকে দেখা যায়, গঙ্গায় ডুবে গিয়েছে কয়েকটি জেটিও।
তবে দুপুর ২টোর পরে পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যেতে শুরু করে। ঝড়ের সতর্কতা হিসেবে বন্ধ রাখা শহরের সেতু ও উড়ালপুলগুলি অবশ্য পরিস্থিতি বুঝে তার আগেই যান চলাচলের জন্য খুলে দিয়েছিল পুলিশ। রাত পর্যন্ত শহরে বাড়ি ভেঙে পড়ার খবর মেলেনি। তবে টালি নালা ও গঙ্গা সংলগ্ন এলাকায় জমা জলের কারণে বিদ্যুৎ পরিষেবা সাময়িক বিঘ্নিত হয়। কয়েকটি গাছ ভেঙে পড়লেও সেগুলি দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়।
বিকেলে লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘তবু আমরা সতর্ক আছি। আগামী ৭২ ঘণ্টা সেই সতর্কতা থাকবে।’’ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও প্রশাসনকে একই নির্দেশ দিয়েছেন। তবে সেই নির্দেশ উড়িয়ে ‘ঝড় আর আসবে না’ বলে এ দিন রাতেই অনেকে জোর করে তাঁদের বিপজ্জনক বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন বলে অভিযোগ। তাঁদেরই এক জন, গিরিশ পার্কের সোহিনী ঘোষ বললেন, ‘‘ঝড় তো হলই না, শুধু শুধু বাড়ি ছেড়ে এলাম। বেশি দিন বাড়ি ছাড়া থাকলে ঘর বেহাত হয়ে যাবে।’’ আর একটি বিপজ্জনক বাড়ির বাসিন্দা, শোভাবাজারের স্নেহাংশু দত্ত বললেন, ‘‘ঝড় আর আসবে না। নিজের বাড়িতেই রাতটুকু ভালয় ভালয় কাটলেই হল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy