নাগেরবাজারের বটতলার একটি দোকানে এ ভাবেই বিকোচ্ছে গঙ্গাজল। নিজস্ব চিত্র
গঙ্গা, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
কুলুকুলু শব্দে উত্তর আসত, “মহাদেবের জটা হইতে।”
এখন প্রশ্নটা কিঞ্চিৎ বদলে গিয়েছে,— গঙ্গাজল, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?
উত্তর আসে, “কেন, মুদির দোকান হইতে!”
ডাকঘর, শহুরে বিপণী, অনলাইন, দশকর্মা ভাণ্ডারের পরে এখন মুদির দোকানে মিলছে গঙ্গাজল। নাগেরবাজার বটতলায় এক দোকানে বসে বাড়ি থেকে লিখে আনা ফর্দ আউড়ে যাচ্ছেন এক প্রৌঢ়, ‘‘মুগডাল ২৫০ গ্রাম, চিনি ৫০০ গ্রাম, বিস্কুট এক প্যাকেট আর এক বোতল গঙ্গাজল।’’
হাতে ফুল-বেলপাতার প্লাস্টিকের প্যাকেট দেখিয়ে সেই প্রৌঢ়ের অনুরোধ, ‘‘ভাই, তুমি আগে গঙ্গাজলের বোতলটাকে এই ব্যাগে দিয়ে দাও। নইলে ডিম কখন ঠেকিয়ে দেবে। সে এক যাচ্ছে তাই ব্যাপার হবে।’’ মুদির দোকানে গঙ্গাজল বিক্রি হতে দেখে পাশ থেকে এক ক্রেতা অবাক হয়ে চেয়ে নিলেন একটি বোতল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি বোতলের গায়ে সাঁটানো স্টিকার দেখছিলেন। আর মুদির দোকানের মালিকও যেন অন্তর্যামী। মোক্ষম সময়ে কানের কাছে এসে তিনি ফিসফিস করলেন, ‘‘আহা, এত দেখার কী
আছে কর্তা, বিশ্বাসে মিলায় গঙ্গা, বাসে বহু দূর...!’’
আরও পড়ুন: পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ মামলা উঠতে পারে আজ
তা কথাটা নেহাত কথার কথা নয়। ভিড় ঠেলে বাস কিংবা মেট্রোয় ওঠো রে। কপাল ভাল থাকলে বসার জায়গা মেলে, নইলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াও রে। অটো, রিকশা ধরে কিংবা নিজে পায়ে গঙ্গার পাড় পর্যন্ত যাও রে! তার পরে ভুরভুরি কাটতে কাটতে বিপ্লবী জ্যারিকেন ডুবে ডুবে জল খাবে। ফের সেই চেনা পথে ফিরে, চেনা গন্তব্যে পৌঁছে ক্লান্ত হাতে কলিংবেলে চাপ... ডিং ডং।
সত্যিই তো, এই ডট কমের যুগে কি এত ধকল পোষায়!
তাই মুদির দোকান! বটতলার মুদিখানা দোকানের মালিক রবীন পাল ও শ্যামল পাল বলছেন, ‘‘বাইরে থেকে টলটলে জল দেখলে হবে? একটু ঝাঁকিয়ে নিন। অ্যাই, অ্যাই দেখেছেন, ঝাঁকালেই কেমন ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। জোয়ারের সময়ে এই জল ভরা
হয়েছে। এই দেখুন, লেবেলেও সেটা লেখা আছে।’’
স্থানীয় বাসিন্দা আলো খান বলছেন, ‘‘বাড়িতে গৃহদেবতা রয়েছে। রোজ পুজো করি। কিন্তু গঙ্গায় গিয়ে জল আনা সম্ভব নয়। তাই পাড়ার দোকান থেকেই কিনে নিই।’’ পাশের এক ফ্ল্যাটবাসী সবিতা বিশ্বাসের আবার এই গঙ্গাজলে বিশ্বাস নেই। তিনি বলছেন, ‘‘ও কিসের না কিসের জল, তার ঠিক নেই। ভরসা পাই না। তাই বাড়ির পরিচারিকা বা চেনাজানা কেউ গঙ্গাস্নানে গেলে তাঁদের দিয়েই এক জ্যারিকেন জল আনিয়ে নিই। অনেক দিন চলে যায়।’’
তাতে অবশ্য গঙ্গাজলের কিস্যু যায় আসে না। বার দুয়েক ঝাঁকুনি খেয়ে পবিত্র পরিচয় দিয়ে দিব্যি বিকোচ্ছে। যেমন অনলাইনে গোমূত্রও এখন মেলে রমরমিয়ে। ডাক বিভাগের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ডাকঘরে ২০১৬ সাল থেকে গঙ্গাজল বিক্রি হচ্ছে। প্রথম বার এসেছিল হৃষিকেশের জল। এ বার এসেছে গঙ্গোত্রীর গঙ্গাজল। ২০০ মিলিলিটারের বোতলের দাম ৩০ টাকা। সেই গঙ্গাজল শহরাঞ্চলে তো বটেই, গ্রামেও বিকোচ্ছে হু হু করে। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরুর পর থেকে এক বছরের মধ্যে ডাক বিভাগের ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্কেল শুধু গঙ্গাজল বিক্রি করেই আয় করেছে ৬ লক্ষ টাকারও বেশি।
যা শুনে শ্যামলবাবু বলছেন, ‘‘এক বার খোঁজ নিয়ে দেখুন, অনলাইনে গঙ্গাজল বিক্রি হচ্ছে ২৪.৫০ টাকা থেকে ৩৯৯ (তিন লিটারের কম্বো প্যাক) টাকায়। আর আমরা ২০ টাকায় বিক্রি করছি এক লিটার গঙ্গাজল। বড়বাজার থেকে এক জন এসে আমাদের মতো বহু দোকানেই গঙ্গাজল দিয়ে যায়। দিনে অন্তত ছ’-সাত বোতল বিক্রিও হয়ে যাচ্ছে।’’
দূষণ বুকে নিয়েই গঙ্গা এখন চাঙ্গা করে যাচ্ছে মরা বাজারও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy