Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
NEET PG 2024

নিট পিজিতে ভর্তির ‘চক্র’ সক্রিয় এখনও! জালিয়াতকে সরাসরি ফোন আনন্দবাজার অনলাইনের, কী জানা গেল?

কে কোন বিষয়ে ডাক্তারিতে পিজি করবেন, তার উপর নির্ভর করে ঠিক হয় ‘রেট কার্ড’। মেডিসিনের জন্য ৯০ লাখ, চোখ-কান-গলার জন্য ৭০ লাখ। কী ভাবে চলে এই কারবার?

Fraudsters targeting doctors ahead of NEET PG over promise of confirmed seats in Government Medical colleges

নিট-পিজিতে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার টোপ! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সারমিন বেগম
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪ ১২:৩৭
Share: Save:

ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায় বেনিয়মের অভিযোগে শোরগোল গোটা দেশে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। একাধিক গ্রেফতারিও হয়েছে। কিন্তু জালিয়াতরা কি তাতে এতটুকুও দমেছে? নিট পিজির নামে এখনও রমরমিয়ে কারবার চালিয়ে যাচ্ছে জালিয়াত চক্র। প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় গোপন রেখে সেই জালিয়াত চক্রেরই এক সদস্যকে সরাসরি ফোন করেছিলাম আমরা। তাতেই ‘বেফাঁস’ নিট-পিজির নামে অসাধু চক্রের কারসাজি! সেই চক্রের সদস্য দাবি করেছেন, নির্দিষ্ট হারে টাকা দিলে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ‘পাকা’। তবে সেই দাবির সত্যতা আছে কি না, তার কোনও উদাহরণ তিনি পেশ করতে পারেননি।

সম্প্রতি রাজ্যের এক চিকিৎসককে ফোন করেছিলেন এক জালিয়াত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চিকিৎসককে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ‘সিট’ পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে চাওয়া হয়েছিল মোটা অঙ্কের টাকা। কী করবেন বুঝতে না পেরে ওই চিকিৎসক সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানান। সেই সূত্র ধরেই আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করে ওই জালিয়াতের সঙ্গে। প্রশ্নফাঁস নয়। কিন্তু যে দাবি ওই জালিয়াত ফোনের কথোপকথনে করেছেন (তার ‘কল রেকর্ড’ রয়েছে আনন্দবাজার অনলাইনের হেফাজতে), তা আরও ভয়ানক! তিনি জানিয়েছেন, দাবি মেনে চক্রকে টাকা দিয়ে দিলে ১০০টি প্রশ্ন ফাঁকা ছেড়ে রেখে এলেও সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সিট পাকা!

কী ভাবে চলে ওই কারবার জানতে চাওয়ায় ওই জালিয়াত চক্রের সদস্য বলেছেন, ২০০টি প্রশ্নের মধ্যে ১০০টি প্রশ্ন ছেড়ে আসতে হবে। যা উত্তর দেওয়ার, তা দিতে হবে বাকি ১০০টি প্রশ্নের। সেখানেও আবার শুধুমাত্র যেগুলিতে উত্তর একেবারে সঠিক নিশ্চিত, নেগেটিভ মার্কিংয়ের কোনও সম্ভাবনা নেই, শুধু সেগুলিরই উত্তর দিতে হবে। জালিয়াতের দাবি, যখন সেই উত্তরপত্র পরীক্ষা করা হবে, তখনই নাকি তাঁদের ‘গ্যাং’ সেই উত্তরপত্রে প্রয়োজনীয় ‘কারসাজি’ করে দেবে। নিট পিজিতে এক একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তরের জন্য ৪ নম্বর থাকে। সে ক্ষেত্রে যে ১০০টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে না, সেগুলিতে ওই চক্র কোনও ভাবে সঠিক উত্তর বসিয়ে দেবে। ফলে ওই ১০০টি প্রশ্নে সরাসরি ৪০০ নম্বর পেয়ে যাবেন সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থী। বাকি যে ১০০টি প্রশ্নের উত্তর ওই পরীক্ষার্থী দিয়েছেন, সেখান থেকে যদি ২০০ নম্বরও আসে, তা হলেও তাঁর মোট ৬০০ নম্বর হয়ে যাবে। ফোনের ও পারে থাকা জালিয়াতের দাবি, এর ফলে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সহজেই ‘সিট’ পাকা হয়ে যাবে।

ওই জালিয়াত চক্রের সদস্য আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে জানিয়েছেন, সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সিটের ‘রেট কার্ড’ও রয়েছে। কে কোন বিষয় পড়বেন, তার উপর নির্ভর করে ‘রেট’। যেমন অর্থোপেডিক্সে পিজি করতে গেলে দিতে হবে ৬০ লাখ টাকা। আবার অন্য একটি অডিয়ো রেকর্ডিংয়ে (যার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) বলতে শোনা যাচ্ছে মেডিসিনে কিংবা সার্জারিতে পিজি করতে গেলে দিতে হবে ৯০ লাখ। স্ত্রীরোগে পিজি করতে গেলে দিতে হবে ৬০ লাখ। চোখ-কান-গলা কিংবা রেডিয়োলজির পিজিতে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সিটের ‘দাম’ ৭০ লাখ।

টাকাপয়সা কখন কী ভাবে দিতে হবে প্রশ্ন করায় ফোনের ও পারের জালিয়াত চক্রের সদস্য জানিয়েছেন, প্রথমে ডকুমেন্ট নেওয়া হবে। তার পরে ‘ভেরিফিকেশন’ (পরীক্ষা) করা হবে। তার পরে ফোন যাবে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীর কাছে। যে, তিনি ওই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চান কি না। সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থী নিশ্চিত করলে প্রথমে ‘টোকেন’ হিসাবে কিছু টাকা দিতে হবে। বাকি টাকা পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পরে। যা লেনদেন চলবে তার পুরোটাই হবে অনলাইনে। নগদের কোনও ব্যাপার নেই। ফলে জালিয়াত চক্রের সঙ্গে কোনও পরীক্ষার্থীর মুখোমুখি দেখা হওয়ারও প্রশ্ন নেই।

কোথা থেকে তাঁদের এই চক্র চলে, সে বিষয়ে অবশ্য কিছুটা ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন করায় কখনও জবাব এসেছে, তাঁদের দফতর দিল্লিতে। আবার কখনও ওই জালিয়াত বলেছেন, ছত্তীসগঢ় থেকে তাঁরা কাজকর্ম চালান। তবে নিজেদের ‘পেশাদারিত্বের’ কথা বোঝাতে কোনও খামতি রাখেননি জালিয়াত চক্রের ওই সদস্য। তাঁর স্পষ্ট দাবি, “আমাদের উপর মহলে চেনাজানা আছে। সেই জন্যই আমরা এটা করতে পারি। শুধু পিজি নয়, এমবিবিএসেও আমরা এই কাজ করি। ছ’-সাত বছর ধরে এই কাজটা করছি।”

কথোপকথনের এই জায়গায় এসে তাঁর সংস্থার নাম জিজ্ঞাসা করায় ফোনকারীর পরিচয় নিয়ে সম্ভবত খানিকটা সন্দেহ হয়েছিল জালিয়াতের। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করতে শুরু করেন। বলেন, পরীক্ষার্থীর নাম কী? তাঁকে পাল্টা বলা হয়, টাকা দিলে তাঁদের চক্র যে সেটা আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে যাবে না, তার কী নিশ্চয়তা রয়েছে? জবাবে সেই জালিয়াত বলেন, প্রয়োজনে যাঁর অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করা হবে, তাঁর আধার কার্ড নম্বর দিয়ে দিতে পারেন। পাঠাতে পারেন প্যান কার্ড নম্বরও। তবে পরিবর্তে তাঁকেও ফোনকারীর নাম জানাতে হবে। সেই দাবিতে তেমন ‘সদুত্তর’ না পেয়ে ওই জালিয়াত ফোনটি কেটে দেন। তার পরে আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে জালিয়াতের দাবি থেকে এটা স্পষ্ট যে, তাঁদের ওই চক্র নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মেডিক্য়ালের আসন ‘বিক্রি’ করে থাকে। যার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে, জালিয়াতের দাবি অনুযায়ী, ‘উপর মহলেরও’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NEET PG 2024 NEET PG NEET Fraud
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE