নাম বদল নিয়ে সংশয় ফাইল চিত্র
‘‘ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্স? হ্যাঁ, নাম পাল্টেছিল তো! সুচিত্রা সেনের নামে হয়েছিল।’’ নিজেরই বোধহয় খটকা লাগল। তাই একটু থমকালেন। তার পরে দ্রুত সংশোধন করে নিলেন কলকাতা পুরসভার আট নম্বর বরোর কোঅর্ডিনেটর সন্দীপরঞ্জন বক্সী। বললেন, ‘‘না, না, ভুল বললাম। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নাম হয়েছিল সুচিত্রা সেন সরণি। কিন্তু ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের তো নতুন নাম হয়নি!’’ ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের নতুন নাম বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নে এমনই উত্তর দিলেন সন্দীপবাবু।
পুর প্রশাসনের একাংশ এখানে অন্য একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সময়টা ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল। টাউন হলে নক্ষত্রখচিত অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শহরের রাস্তা, সেতু-সহ মোট ১৭টি নতুন নামকরণের ফলক উন্মোচন করলেন। সেখানে পুরসভা জানিয়েছিল, এখন থেকে শহরের কোনও রাস্তা, সেতু, উড়ালপুলের নতুন নামের সঙ্গে সেই সংক্রান্ত তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কলকাতার কী যোগসূত্র, সেই সম্বলিত ফলক বসানো হবে।
কিন্তু তার পরে আট বছর কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে শহরের জনসংখ্যাও বেড়েছে। আর সেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভিড়ে পুরসভার নতুন ফলকের ঘোষণা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে!
যেমন শুধু বরো কোঅর্ডিনেটর সন্দীপবাবুই নন, প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ই জানেন না, ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের নতুন নাম আদৌ ‘কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সরণি’ হয়েছে কি না! স্বাতীদেবীর কথায়, ‘‘ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্স সুনীলের নামে? কেউ জানায়নি তো! আমি সংবাদপত্র থেকে জেনেছিলাম যে, ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের নতুন নাম সুনীলের নামে হয়েছে। পুরসভা আমায় কিছু জানায়নি।’’ তিনি আরও বলছেন, ‘‘সুনীলের নামে ফলক বা সাইনেজ আমার বা আমার পরিচিত কারও চোখেই পড়েনি। পুরসভার এই ঘোষণায় অহেতুক আমাকে বিব্রত হতে হল! নাম পাল্টানোর দরকারই বা কী ছিল!’’
অথচ পুরসভার রাস্তা নামকরণ কমিটির (রোড রিনেমিং কমিটি) চেয়ারম্যান কবি জয় গোস্বামী বলছেন, ‘‘ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছিল ২০১৯ সালেই।’’ কারণ, সেখানকারই এক আবাসনের এ২/৯ নম্বর ফ্ল্যাটে বসে বছরের পর বছর বাংলা সাহিত্যে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন ‘নীললোহিত’।
স্বাতীদেবীকে জানানোর প্রসঙ্গে পুর সচিবালয় দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলছেন, ‘‘আমাদের তরফে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে কিছু জানানো হয়নি। সাধারণত কোনও এলাকা থেকে নামকরণের প্রস্তাব এলে তবেই সেখানে বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু এটা তো পুরসভার সিদ্ধান্ত ছিল।’’ পুরসভার সিদ্ধান্ত হলেও যাঁর নামে রাস্তার নাম, তাঁর পরিবারকে জানানোর ‘সৌজন্য’টুকু পুরসভা দেখাবে না?— প্রশ্ন অনেকের।
তা ছাড়া রাস্তার নাম পরিবর্তন-তথ্য সংশ্লিষ্ট এলাকার ডাকঘরেও সরকারি ভাবে জানানোর কথা পুরসভার। কিন্তু বালিগঞ্জ ডাকঘরের এক কর্তার কথায়, ‘‘এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাককর্মীরাও জানেন না ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের নতুন নামের বিষয়টি। কোনও বোর্ডও তাঁদের নজরে পড়েনি।’’
অথচ পুর সচিব হরিহরপ্রসাদ মণ্ডল জানাচ্ছেন, নতুন নাম আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হওয়ার পরেই তা পুরসভার সিভিল ও অ্যাসেসমেন্ট দফতরকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
সিভিল দফতরকে বলা হয় নতুন নাম সম্বলিত ফলক সংশ্লিষ্ট রাস্তায় লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। একই ভাবে অ্যাসেসমেন্ট দফতরকে বলা হয়, নতুন নামকরণ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রাস্তায় থাকা সব সম্পত্তির মূল্যায়ন করার জন্য। যার পরিপ্রেক্ষিতে সিভিল দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘ফলক লাগানো হয়েছে কি না, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’’ আর অ্যাসেসমেন্ট দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের নাম বদলেছে? জানি না তো!’’
ফলে পুরসভার সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তবায়ন এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের ‘ফারাক’ এই ঘটনায় আরও এক বার প্রকাশ্যে এসেছে বলে মনে করছেন অনেকে। স্থানীয় ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর সুদর্শনা মুখোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘সংবাদপত্র থেকে জেনেছি, নাম পাল্টেছে। তবে এ সংক্রান্ত কোনও নির্দেশিকা আমাদের ওয়ার্ড অফিসে আসেনি। এলাকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে কোনও ফলক বা বোর্ডও লাগানো হয়নি।’’
যার পরিপ্রেক্ষিতে জয় বলছেন, ‘‘পুরসভা কেন স্বাতীদিকে জানায়নি, কেনই বা নামফলক লাগানো হয়নি, বলতে পারব না। এগুলো পুরোপুরি পুরসভার দায়িত্ব।’’
জয় ঠিকই বলেছেন। এটা পুর কর্তৃপক্ষেরই দায়িত্ব। কিন্তু সেটা কার বা কোন দফতরের?— শহরের রাস্তার অগুনতি নতুন নামের মতো সেই উত্তরও আপাতত গোলকধাঁধাঁয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy