Advertisement
০৫ জুলাই ২০২৪
Electricity Theft

ফুটপাত থেকে বহুতল, চুরির বিদ্যুতের রমরমা থামবে কবে?

শহরবাসীর ভোগান্তি কতটা গভীরে? মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার পরে খোঁজ করছে আনন্দবাজার।

—প্রতীকী ছবি।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪ ০৮:৩৬
Share: Save:

ঘিঞ্জি এলাকায় ছোট জায়গার মধ্যেই উঠেছে পাঁচতলা বাড়ি। তাতে তৈরি হওয়া ১৫টি ফ্ল্যাটে বসবাস করে মোট ২২টি পরিবার। অথচ, বিদ্যুৎ পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা খোঁজ করতে গিয়ে দেখছে, সেখানে বিদ্যুতের বৈধ মিটার রয়েছে মাত্র দু’টি। তা-ও শুধু আলো, পাখা আর একটি টেলিভিশন চালানোর কম ক্ষমতার ছাড়পত্র রয়েছে সেগুলির। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, এই বাড়িতেই রমরমিয়ে চলছে একাধিক ওয়াশিং মেশিন, রেফ্রিজ়ারেটর। প্রায় ঘরে ঘরে রয়েছে বাতানূকুল যন্ত্রও!

কী করে সম্ভব? খোঁজখবর করতেই বিদ্যুৎ সংস্থার কর্মীরা দেখলেন, বড় রাস্তা থেকে দু’টি মোটা তার এসেছে ওই বহুতল পর্যন্ত। একটি তার বিদ্যুৎ সংস্থার বক্সের মধ্যে ঢোকানো, অন্যটি সরাসরি পুরসভার খুঁটির গায়ে জড়ানো। দিনের পর দিন এই দুই পথেই চোরাই বিদ্যুৎ পৌঁছচ্ছে ওই বহুতলে। কোনও ভাড়া দেওয়ার ব্যাপার নেই। বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে আলাদা করে আবেদন করারও বালাই নেই। মাসে স্থানীয় কয়েক জনকে আলো-পাখার খরচ হিসাবে কিছু টাকা দিলেই চলে! নবান্ন থেকে সম্প্রতি এমন চুরির বিদ্যুৎ নিয়েই সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘কী করে চুরির বিদ্যুৎ দিনের পর দিন ব্যবহার হচ্ছে?’’ তিনি বলেছেন, ‘‘বেআইনি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে যাচ্ছে কী করে? দ্রুত সব ঠিক না করলে কড়া ব্যবস্থা নেব।’’

কিন্তু সচেতন নাগরিক থেকে বিদ্যুৎ সংস্থার কর্মীদের বড় অংশেরই দাবি, চুরির বিদ্যুৎ নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে এমন হুঁশিয়ারি অতীতেও এসেছে বহু বার। কিন্তু চুরি থামেনি। উল্টে কেব‌্ল তারের পাশাপাশি চুরির বিদ্যুতের তারেও শহরের আকাশ ঢেকেছে। বিদ্যুৎ সংস্থা সিইএসসি-র লস কন্ট্রোল সেল (লোকসান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) সূত্রেই খবর, নারকেলডাঙা, একবালপুর, মোমিনপুর, খিদিরপুর, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজের পাশাপাশি একই রকম অবস্থা কামারহাটি, রাজাবাজার, এন্টালি, চিৎপুর, কাশীপুর, তপসিয়া, তিলজলার মতো এলাকাগুলিতেও। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রে আবার জানা যাচ্ছে, বর্তমানে ১০০ টাকার বিদ্যুৎ জোগান দিলে বণ্টনকারী সংস্থার ঘরে ফেরত আসে ৩০ টাকার কাছাকাছি। বাকি ৭০ টাকার বিদ্যুৎই বেমালুম চুরি হয়ে যায়! মিটারের কাছে বিদ্যুতের তার সিল করে দিয়ে বা ‘কোএক্সিয়াল’ তার ব্যবহার করেও চুরি আটকানো যাচ্ছে না বলে খবর। প্লাস্টিকের বর্ম লাগানো বিদ্যুৎ সংস্থার তারের উপরের অংশ কেটে ভিতরের তার বার করে নেওয়া হচ্ছে। এর পরে সেই তারের সঙ্গেই হুকিং করে চলছে আলো, পাখা, বাতানূকূল যন্ত্র। পুরসভার বাতিস্তম্ভ থেকেও একই ভাবে চুরি করা হচ্ছে বিদ্যুৎ।

রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘বহু এলাকায় ডেকরেটর্স ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্থানীয় নেতার যোগসাজশে বিদ্যুৎ চুরির ব্যবসা ফেঁদে বসা হয়েছে।’’ ডেকরেটর্স সংস্থার হয়ে যিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে তার কেটে বার করছেন, তিনি নিচ্ছেন সংযোগ পিছু ৫০ টাকা। এর পর আলো, পাখা আর টেলিভিশন চালানোর খরচ কোনও এলাকায় মাসে ১০০ টাকা, কোথাও আবার ১২০-১৫০ টাকা। ফ্রিজ় বা ওয়াশিং মেশিন চললে এর সঙ্গেই যুক্ত হচ্ছে আরও ১০০ টাকা। বাতানূকুল যন্ত্র চালাতে হলে দিতে হচ্ছে বাড়তি আরও ২০০ টাকা। সবটাই যাচ্ছে স্থানীয় ওই নেতা-দাদাদের কাছে। সিইএসসি-র এক কর্তা আবার বললেন, ‘‘বেআইনি বহুতলের ফ্ল্যাট যাঁরা কেনেন, তাঁদের অনেকের কাছেই যথাযথ নথি থাকে না। বাইরে থেকে শহরে এসে ঢোকার কারণে ব্যক্তিগত পরিচয়পত্রও নেই অনেকের। তাই তাঁদের অনেকেই বৈধ পথে বিদ্যুতের মিটার পাওয়ার আবেদন করেন না।’’ এক দল স্থানীয় নেতা নিজের ব্যবস্থা করা মিটার থেকেই তাঁদের বিদ্যুৎ দিয়ে দেন বলে অভিযোগ। এতেই বিদ্যুতের লোকসান যেমন কমে না, তেমনই সরকার চাইলেও বেআইনি বহুতলে ফ্ল্যাট বিক্রি বন্ধ করতে পারে না বলে জানাচ্ছেন ওই কর্তা।

তা হলে উপায়? বিদ্যুৎ সংস্থার কর্তাদের দাবি, যে শহরে টাকা দিলে ফুটপাতেও চোরাই বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, সেখানে বহুতলে বেআইনি বিদ্যুৎ সংযোগ খুঁজতে যাবেন কে? প্রশ্ন থেকে যায়, উত্তর মেলে না।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata electricity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE