প্রস্তুতি: নতুন চিনা বছর ষাঁড়ের নামে। তাই তৈরি হয়েছে এই মূর্তি। বৃহস্পতিবার, ট্যাংরায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
বেশির ভাগই হিন্দিতে সব থেকে বেশি সড়গড়। জন্মেও চিনের ধারেকাছে যাননি ওঁরা।
তবু করোনা-কালের উটকো ঝামেলায় নানা ঝড় বয়েছে তাঁদের উপরে। ভারত-চিন টানাপড়েনের পটভূমিতেও খামোখা ‘দেশপ্রেমের’ পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল তাঁদের। লকডাউনের সময়ে তাঁরা অনেকেই জাতধর্ম না-দেখে শহরবাসীর পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছিলেন। আজ, শুক্রবার চিনা নববর্ষের প্রাক্কালে ফের কলকাতার সবার রঙে রং মেশানোর ডাক দিলেন ওঁরা। করোনা-সতর্কতা মেনেও উৎসবের রঙে সেজে উঠল ট্যাংরা, টেরিটিবাজার।
১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের পর থেকে ক্রমশ কলকাতার কয়েকটি বাছাই এলাকাতেই চিনাদের ভিড় বেড়েছে। তবে সেখানেও এখন নানা রঙা সংস্কৃতির ছোঁয়াচ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চিনা কালীবাড়ি তল্লাটে আলোর ঝালরই উৎসবের মেজাজটা বেঁধে দিল। ক্রিস্টোফার রোডের তাপস অধিকারীর জন্যও দিনটা বিশেষই বটে। চিনা নতুন বছরগুলো বাঘ, ষাঁড়, ড্রাগন, বাঁদরের মতো নানা পশুর নামে। ট্যাংরার পি মে স্কুলে এ বার ‘ইয়ার অব দ্য অক্স’ উপলক্ষে প্রকাণ্ড ষাঁড় তৈরির বরাত বন্ধু জোসেফ চেনের মাধ্যমে তাপসের ঘাড়ে পড়েছে। স্থানীয় বিহারি সমাজের ‘জাগরণ’ উপলক্ষে শেরাওয়ালি মা বা সরস্বতী ঠাকুরের বরাতের ফাঁকে মাটির বড়সড় আসল ষাঁড়ের মাপের ষাঁড়টাও তাঁকে গড়তে হয়েছে। বছর দুয়েক আগে ট্যাংরার চিনাদের মস্ত ড্রাগনও গড়েছিলেন তাপস। আজ, শুক্রবার সকালে ষাঁড়টাকে স্কুলবাড়ির উৎসব-মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার কথা।
ট্যাংরার বর্ষবরণ উৎসবের অন্যতম আহ্বায়ক, সেখানকারই প্রভাবশালী রেস্তরাঁ-কারবারি মনিকা লিউ বলছিলেন, “দিন কুড়ি আগে উৎসবের পরিকল্পনা করা হল। তবে অন্য বারের জৌলুস থাকবে না। পিছনের গোটা বছরটা কারও ভাল কাটেনি। ইন্ডিয়ান চাইনিজ কমিউনিটিকে একটু চাঙ্গা করার দরকার ছিল।” চিন-বিদ্বেষের আবহে স্থানীয় রেস্তরাঁ-কর্তা ওয়াল্টার চেনের রেস্তরাঁতেও স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতী লুটপাট চালায় বলে অভিযোগ। সেই ওয়াল্টার, ট্যানারি-কর্তা জোসেফ বা মিনারেল ওয়াটার-কারবারি ডমিনিক শি মিলে মনিকা লিউয়ের সঙ্গে লকডাউন-পর্বে জাতধর্ম নির্বিশেষে স্থানীয় মানুষের খাবার জুগিয়েছেন।
ওয়াল্টার যাদবপুরের কমিউনিটি কিচেনকেও সাহায্য করেন। তাঁরাই একজোট হয়ে নববর্ষের আয়োজনের হোতা। তবে মনিকা জানালেন, ট্যাংরার ঝলমলে কার্নিভ্যাল এ বার হচ্ছে না। তার বদলে পি মে স্কুলে স্থানীয় চিনা গিন্নিদের ফুড ফেস্টিভ্যাল হবে। তাতে রকমারি মাছ-মাংসের ডাম্পলিং, মাংসের পুর ভরা রুটি বাও ইত্যাদির সঙ্গে কলকাতার চিনাদের বিশেষ প্রিয় ডালপুরি, বিরিয়ানি, বাঙালি চিকেন কারিও থাকার কথা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও চিনা ভাষার সঙ্গে মিশবে ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা গান। প্রযুক্তির কৌশলে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ উপস্থাপনারও ব্যবস্থা হচ্ছে। তাপসবাবুর তৈরি ষাঁড় বাবাজিকে সেখানেই এনে নিজস্বী-মঞ্চ বাঁধার কথা। মনিকা, জোসেফরা বার বার বলছিলেন, করোনা-সতর্কতা, মাস্ক, স্যানিটাইজ়েশন এবং দূরত্ব বজায় রাখায় আপস করা হবে না।
শহরের কমবেশি হাজার আড়াই চিনা বাসিন্দার আত্মীয়েরা অনেকেই ছড়িয়ে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায়। অতিমারিতে যাঁদের অনেকেই বচ্ছরকার উৎসবে কলকাতায় ফিরতে পারছেন না। তবু টেরিটিবাজারের সস কারখানার কর্তা ডমিনিক লি-র কন্যা এ দিনই এক বছর বাদে কানাডা থেকে নিজের শহরে ফিরছেন।
এক সময়ে কলকাতা মাতিয়ে রাখা চিনাদের লায়ন ডান্সের দলগুলোও অনেকে শহরছাড়া হওয়ায় ভেঙে গিয়েছে। তবু ট্যাংরার দুই ভাই জোসেফ ও জর্ডনের দলটা বর্ষবরণের সন্ধ্যায় মাতিয়ে রাখল ওই এলাকা। প্রথা মেনে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এই রঙিন মাঙ্গলিক অভিযান। বছরের প্রথম সকালে তাদের টেরিটিবাজার যাওয়ার কথা। তরুণ গায়ক, বৌবাজারের ফ্রান্সিস ই লেপচা ঝরঝরে বাংলায় বলছিলেন, “কলকাতার বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে চাইনিজ নিউ ইয়ারকে ভুলবেন না।” চিনাদের কাছে ষাঁড় হল জেদ এবং পরিশ্রমের প্রতীক। টেরিটিবাজার, বো ব্যারাক, ট্যাংরায় ষাঁড়ের বছরের উৎসবে এ বার ঘুরে দাঁড়ানোরও সঙ্কল্প।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy