Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

‘ছোট ছোট গর্তে জমানো রয়েছে আমাদের চোখের জল’

‘‘সে দিন যাঁরা দৌড়ে এসে জানতে চেয়েছিলেন আমরা ঠিক আছি কি না, তাঁদের মধ্যে কেউ কিন্তু মুসলিম ছিলেন না। সকলেই হিন্দু ছিলেন। ওঁরা যে হিন্দু, সেটাই কখনও আলাদা করে ভাবিনি!’’

স্মরণ: নাখোদা মসজিদের কবরস্থানে বসে স্মৃতি রোমন্থন আব্দুল মজিদের। সোমবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

স্মরণ: নাখোদা মসজিদের কবরস্থানে বসে স্মৃতি রোমন্থন আব্দুল মজিদের। সোমবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:৩১
Share: Save:

বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হয়েছিল, তখন কবরে বোমা মেরেছিল কেউ বা কারা। শহরের অন্যতম পুরনো এই কবরস্থান এবং লাগোয়া মাজারে বোমা মারার ঘটনা সেই প্রথম। আশপাশের প্রতিবেশীরা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়েও এসেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, তাঁরা ঠিক আছেন তো?

ছায়াঘেরা এলাকা। কিছুটা দূরেই যান-কোলাহলে ভর্তি এপিসি রোড। শীতের আলো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে গাছগাছালি ঢাকা কবরস্থানে। তারই এক পাশে দাঁড়িয়ে পুরনো দিনের কথা বলছিলেন আব্দুল মজিদ। নাখোদা মসজিদের নিজস্ব এই কবরস্থানের দেখভালের দায়িত্ব আব্দুলরা চার প্রজন্ম ধরে পালন করে আসছেন।

আব্দুল বলছিলেন, ‘‘সে দিন যাঁরা দৌড়ে এসে জানতে চেয়েছিলেন আমরা ঠিক আছি কি না, তাঁদের মধ্যে কেউ কিন্তু মুসলিম ছিলেন না। সকলেই হিন্দু ছিলেন। ওঁরা যে হিন্দু, সেটাই কখনও আলাদা করে ভাবিনি!’’ এখন ভাবেন? প্রশ্ন শুনে কিছুটা থমকালেন বছর পঁয়ষট্টির আব্দুল। বললেন, ‘‘বছরের শেষটা যেমন গেল, তাতে তো ভাবতেই হচ্ছে। তা-ও বলব সকলে নয়, কয়েক জন মিলে এই হিন্দু-মুসলিম পার্থক্যটা করছেন। নতুন বছরে হয়তো এই অন্ধকার কেটে যাবে।’’

‘‘বিশ্বাস করুন, যাঁরা এই পার্থক্যটা করছেন, তাঁরা রাজনৈতিক কারণে করছেন’’, আব্দুলের কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশ থেকে কথাগুলো বলে উঠলেন তাঁর ছেলে মহম্মদ শাহিদ। মাজারে বোমা পড়ার ঘটনার সময়ে নিরাপত্তার কারণে তাঁদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রতিবেশীরাই বলেছিলেন নিয়ে যেতে। যাতে ওই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আব্দুলদের কোনও ক্ষতি না হয়। তখন শাহিদের বয়স ছিল মাত্র আট। এখন শাহিদ পঁয়ত্রিশের যুবক। তিনি বলছিলেন, ‘‘সে দিন যাঁরা আমাদের জন্য দৌড়ে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন আর নেই। হয় অন্যত্র চলে গিয়েছেন অথবা মারা গিয়েছেন। কিন্তু হিন্দু হলেও তাঁরা সকলেই আমার বাবাকে ভাইয়ের মতো দেখতেন। আর আমাকে ভাইপো হিসেবে মানতেন।’’ আসবাবপত্র তৈরির কাজ করেন শাহিদ। পাশাপাশি নাখোদা মসজিদের ট্রাস্টির সদস্য-পরিবারের কারও মৃত্যু হলে তাঁকে কবর দেওয়ার কাজে আব্দুলকে সাহায্য করেন তিনি। শাহিদ বলছিলেন, ‘‘হঠাৎ করেই সব কিছু পাল্টে গেল। এখন যে শোরগোল চলছে, সেটা একবারেই নতুন আমাদের কাছে। এমনটা আগে কখনও দেখিনি।’’ পরিস্থিতি যাতে ঘোরালো না হয়, সে কারণে নাখোদা মসজিদ কর্তৃপক্ষ অন্যদের মতো তাঁদের কাছেও মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে কোনও ঝামেলায় না জড়ানোর আবেদন করেছেন।

যদিও বাইরের ঝামেলার প্রভাব এখনও পর্যন্ত কবরস্থানে পড়েনি বলেই জানালেন আব্দুল-শাহিদ। নিঝুম এই কবরস্থানে অপার শান্তি। আব্দুল বলছিলেন, ‘‘শুধু কী মুসলমান? হিন্দুরাও এই মাজারে এসে প্রণাম করে যান। বরাবর তো এ রকমই ছিল।’’ কবরস্থানের শান্তি যাতে কোনও ভাবেই বিঘ্নিত না হয়, সে দিকে কড়া নজর বাবা-ছেলের। শাহিদ জানালেন, তাই মাজারে বসে কেউ হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গ তুললে তাঁদের কবরস্থানের বাইরে গিয়ে আলোচনা করতে বলেন তাঁরা। শাহিদ বলছিলেন, ‘‘হিন্দুরা মৃতদেহ দাহ করেন। আর মুসলমানদের কবর দেওয়া হয়। আমরা বেশি পড়াশোনা জানি না, তাই আমাদের কাছে পার্থক্য তো শুধু এটুকুই।’’

এই যুবক অবশ্য ইদানীং শুনছেন, ‘পড়াশোনা জানা’ লোকেদেরই কেউ কেউ এই চেনা বৃত্ত পাল্টে দিতে চাইছেন। চাইছেন আবহমানকাল ধরে যা কিছু সাধারণ, তার মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে। তাঁরা চাইছেন, প্রতিবেশী নয়, বরং তিনি হিন্দু না মুসলমান, সেই পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে উঠুক।

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওবাইদুল্লা ফাহাদ বলছেন, ‘‘আগুনে জ্বালানোর পরে দেহ যেমন ছাই হয়ে যায়, কবর দেওয়ার পরে তেমনই মৃতদেহ মাটিতে মিশে যায়। মাটিতে মিশলে হিন্দু-মুসলিম নয়, তখন আমরা সবাই ভারতীয়! এটা কেন অনেকে ভুলে যাচ্ছে!’’

সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘রাস্তার ছোট ছোট গর্তে জমানো রয়েছে আমাদের চোখের জল।’ ব্যস্ততম এপিসি রোড লাগোয়া এই কবরস্থানে তেমনই যেন সারিবদ্ধ ভাবে শায়িত রয়েছে কোনও মুসলিম নয়, বরং ভারতীয়ের অস্থিমজ্জা। যা ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে এ দেশের মাটিতে। মাটির মধ্যে মাটি হয়ে, আবহমান অশ্রুবিন্দুর মতো!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE