মনে রেখে: উজ্জ্বল প্রাক্তনী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা ঢাকুরিয়ার বিনোদিনী গার্লস হাইস্কুলে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
তিনি বাংলা মাধ্যমের ছাত্রী। জীবনের যাবতীয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্যে এই পরিচয়ও যেন তাঁর এক গয়না! বুধবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার পরের দিন এ শহরের এক আপাত অকিঞ্চিৎকর বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছবিটাও পাল্টে গেল।
কোভিড-পরবর্তী পর্বে এ রাজ্যে সব পড়ুয়ার প্রথম বার স্কুলে ফেরার সকাল! তবু সকালটা যেন অতটা মিষ্টি ছিল না ঢাকুরিয়ার বিনোদিনী গার্লস হাইস্কুলে। প্রধান শিক্ষিকা দীপান্বিতা রায়চৌধুরীর সাতসকালেই খেয়াল হয়েছে স্কুলের আট দশকের ইতিহাসে সব থেকে গর্বের প্রাক্তনীর কথা! এই স্কুলের মনে-প্রাণে এখনও একাকার বাঙালির গীতশ্রী। ‘‘মেয়েদের সন্ধ্যাদির লড়াইয়ের গল্প বলব আমরা। তাঁর কথা বলেই হয়তো এখনও অনেকের চোখে দুয়োরানি এই সাবেক বাংলা মিডিয়াম স্কুলের পড়ুয়াদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো যাবে’’— বলছিলেন প্রধান শিক্ষিকা।
বাংলায় না-ফিরে বম্বেতে পড়ে থাকলে হয়তো সর্বভারতীয় খ্যাতির চুড়োয় পৌঁছতেন গীতশ্রী। কিন্তু তার থেকে বড় সত্যি বাঙালির রোম্যান্টিকতার চিরন্তন প্রতীক সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একদা যিনি এক সাধারণ মেয়ের হেলায় চন্দন-পালঙ্ক তুচ্ছ করার স্পর্ধা জাগিয়ে তুলেছেন। সেই সন্ধ্যার স্কুলে দ্বিপ্রাহরিক টিফিন-বিরতিতে লাউডস্পিকারে ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ বেজে উঠতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল কমলা ওড়না, সাদা পোশাকের পরির দল। ঘটনাচক্রে আজই উচ্চ মাধ্যমিকের মিউজ়িক প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা। সঙ্ঘমিত্রা সোম, কুমুদ বন্দ্যোপাধ্যায়রা বলে ওঠে, ‘‘মিউজ়িক পরীক্ষায় সন্ধ্যাদির গান থেকে প্রশ্ন ধরবে না কি!’’
সোনারপুরের স্নেহা আরি মনের আনন্দে দু’কলি ‘মধুমালতী ডাকে আয়’ গাইলেও বাংলার দিদিমণি অপর্ণা চক্রবর্তী, কর্মশিক্ষার সুজাতা করেরা আফশোস করেন, সময় পাল্টেছে! ছোট থেকে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখে বা সন্ধ্যা-হেমন্ত-মান্নার গান শুনে বড় হওয়া ছাত্রী কমই আসে! সঙ্ঘমিত্রা, কুমুদেরা যেমন ‘মধুমালতী ডাকে আয়’ বা ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ আগে শুনলেও এ সবই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান কি না, নিশ্চিত ছিল না। আসলে সন্ধ্যাদিদির যত বয়স বেড়েছে, সময়ও পাল্টেছে। প্রধান শিক্ষিকা দীপান্বিতা বলছিলেন, অন্যত্র আর-পাঁচটা বাংলা মাধ্যম স্কুলে যেমন, এই স্কুলেও বিত্তমধ্য স্তরের পড়ুয়া এখন কম। ছোটখাটো চাকরি করা, লড়াকু পরিবার থেকে আসা মেয়েরাই সংখ্যায় বেশি। কিন্তু প্রধান শিক্ষিকা গর্বিত, ‘‘এখনও অন্য স্কুলগুলোর মতো পড়ুয়ার অভাব হয়নি।’’ কম-বেশি ১৯০০ পড়ুয়া এই স্কুলে। দু’বছর বাদে প্রথম ক্লাসের দিন স্কুল গম গম করছে।
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত উনি আসতে পারুন না পারুন, সরস্বতী পুজোয় স্কুলের জীবন্ত সরস্বতী সন্ধ্যাদিকে নেমন্তন্ন করার রেওয়াজ ছিল। শেষের দিকে সেই যোগসূত্র ক্ষীণ হয়েছে। কয়েক বছর আগে স্কুলের প্ল্যাটিনাম জুবিলিতে উনি আসতে পারেননি। তবে ১৯৯৮ নাগাদ হীরক জয়ন্তীতে সন্ধ্যার স্কুলে আসার গল্প মুখে মুখে ফেরে! এই স্কুলেরই এক প্রাক্তনী শতাব্দী দাশ কিছু দিন আগে সমাজমাধ্যমে শোনাচ্ছিলেন, আমন্ত্রণ জানাতে সন্ধ্যার বাড়ি গেলে গীতিকার শ্যামল গুপ্ত নিজে স্ত্রীর স্কুলের মেয়েদের জল-মিষ্টি দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। তিনি বলেন, “স্কুলে গাদা-গাদা বিখ্যাত প্রাক্তনী না-থাকলেও এক জন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় একাই একশো!” স্কুলের ওই সময়ের দু’জন শিক্ষিকা অপর্ণা, সুজাতাদের মনে আছে, সবার অনুরোধে সন্ধ্যা গান ধরেন, ‘বকম বকম পায়রা তোদের রকমসকম দেখে’! তার আগে বলেন, স্কুলের দরজা-জানলা বন্ধ করতে। গানের শব্দ যেন বাইরে না যায়! তা হলে এখনই স্কুল তল্লাটে ভিড় হতে পারে!
যাঁর নামে স্কুলের নাম, অনেক দিন আগের স্থানীয় বধূ বিনোদিনীদেবীর বাড়ির মেয়ে, সন্ধ্যার সহপাঠী রমলা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এখনও স্কুলের নিবিড় যোগাযোগ। সন্ধ্যার কন্যা সৌমীও এক ডাকে চেনেন রমলামাসিকে। রমলা এ দিন বলছিলেন সন্ধ্যার সঙ্গে কয়েক দশকের অটুট সম্পর্কের কথা! “সন্ধ্যার দাদাদের কড়া শাসন থাকলেও আমার আর শেফালি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গল্প করতে ও ঠিক নানা ছুতোয় সময় করে নিত। এবং সে দিনের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও কম বিখ্যাত নয়। গীতশ্রী পরীক্ষার খেতাব ছাড়াও আকাশবাণীর মহিষাসুরমর্দিনীর লাইভ রেকর্ডিংয়ের অভিজ্ঞতা ওর ঝুলিতে। হাঁ করে সব শুনতাম!’’ ১৯৪৬-’৪৮ সালে বিনোদিনী স্কুলে পড়ার পরে বম্বে পাড়ি দেন সন্ধ্যা। কিন্তু বন্ধুত্ব ভাঙেনি। তিন বছর আগেও রমলার বাড়িতে আসেন সন্ধ্যা। তাঁর ছেলে কুশলকেও খুবই স্নেহ করতেন।
সুরের আকাশে ডানা মেলেও মাটিতে পা রাখা এই সন্ধ্যার গল্পই স্কুলের আগামীর প্রেরণা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy