হাতিবাগান বাজারে অলোককুমার দালাল। —নিজস্ব চিত্র।
শীর্ণকায় চেহারা! এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে বাদাম-ছোলা ভাজার প্যাকেট। কাঁধে আবার ব্যাগ ঝুলছে। লাঠিতে ভর দিয়ে কোনও মতে হাঁটছেন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ! হাতে ঝোলানো প্যাকেট দেখে বাজারের ভিড় থেকে কেউ কিছু কিনতে এলেই তড়িঘড়ি কাঁধের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে থাকা কাগজের একটি নিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছেন হাতে। এর পরে ক্রেতার পছন্দের জিনিস দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে ধরানো ‘কাগজ’ দেখিয়ে চলছে অনর্গল ইংরেজির পাঠ। ইংরেজির ভয় কাটাতে প্রতিদিন এ ভাবেই বাদাম বিক্রির পাশাপাশি শহরের রাস্তায় ‘লিফলেট’ বিলি করেন ওই সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ।
আদতে নিউ ব্যারাকপুরের বাসিন্দা এই বৃদ্ধের নাম অলোককুমার দালাল। বছর ৭৭-এর বৃদ্ধের বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী, মেয়ে। স্ত্রী কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেন মেয়েও। আপাত সচ্ছল পরিবার হলেও শেখানোর নেশায় প্রতিদিনই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন অলোককুমার। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম প্রথম শুধু লিফলেট দিতাম। তাতে দেখলাম, সবাই নিতে চাইতেন না। অন্য কিছু ভাবতেন। তাই এখন বাদাম সঙ্গে করে নিয়ে বেরোই।
কেউ কিনতে এলেই হাতে লিফলেটটা দিয়ে দিই। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে হলে তো হাতে ধরে শিখিয়ে দিই।’’ এক পাতার লিফলেটের এক দিকে ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলার কৌশল ছাপানো। অন্য দিকে রয়েছে ইংরেজি ব্যাকরণ শেখার কয়েকটি পদ্ধতি। বৃদ্ধের দাবি, ‘‘এগুলো শিখে নিতে পারলেই আর বিশেষ কিছু লাগে না। এর পরে একটু মাথা খাটালেই সহজ হয়ে যাবে ইংরেজি পাঠ।’’
বৃদ্ধ নিজেই জানালেন, কোথাও চাকরি না করলেও আগে নিউ ব্যারাকপুরে বাড়িতেই ইংরেজি পড়াতেন। ছোট থেকেই ইংরেজির উপরে ‘দখল’ থাকায় পাড়ার অনেকেই তাঁর কাছে পড়তে আসতেন। প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এলাকায় ইংরেজি পড়ানোর পরে বয়েসের কারণে সব ছেড়ে দেন। অলোকবাবু বলেন, ‘‘পড়ানোর সময় থেকে দেখছি, অধিকাংশ পড়ুয়াই যেন ইংরেজির নাম শুনলেই ভয়ে জড়সড় হয়ে যেত। আমি মনে করি, এই ভয় কাটাতে পারলেই সহজ হবে শেখা। তাই নিজেই কয়েকটি ছোট পদ্ধতি বানিয়ে ফেলি।’’
সিঁথি, শিয়ালদহ চত্বরে মাঝেমধ্যে গেলেও সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন হাতিবাগান বাজারেই ঘোরেন বৃদ্ধ। সকাল ১০টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোন। এর পরে সারা দিন ঘুরে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরেন। পরিবারের সকলের আপত্তি থাকলেও এই রুটিনে ছেদ পড়ে না। এমনকি, করোনার বিপদের সময়েও এই কাজ তিনি চালিয়ে গিয়েছেন বলে জানান। বৃদ্ধ বলেন, ‘‘বাড়িতে সবাই বারণ করে। কিন্তু আমার ভাল লাগে। সেই সঙ্গে হাঁটাচলাও হয়ে যায়, আর কিছু পড়ুয়ার ভয় ভাঙানো হয়। আমার এটাই ভাল লাগে। তাই করি।’’
ছেলেমেয়েকে পড়ানোর কথা বলে প্রতিদিন অনেকে তাঁকে ফোন করেন বলেও জানাচ্ছেন অলোকবাবু। তবে বয়সের কারণে সবাইকে না বলে দেন বলেই তিনি জানান। এমনকি, লিফলেট বিলির জন্য কোনও অতিরিক্ত টাকা নেন না। নিজের খরচেই ছাপিয়ে আনেন সেগুলি। তিনি জানান, বছর পাঁচেক ধরে তিনি লিফলেট বিলি করছেন। বাজার এলাকায় সকলের কাছে ‘ইংরেজি দাদু’ বলেও পরিচিত হয়ে গিয়েছেন। সম্প্রতি অনেকে লিফলেট ছাপিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়েও আসেন। তবে সাহায্য নিতে বিশেষ আগ্রহ নেই বৃদ্ধের। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো রোজগারের জন্য তো কিছু করি না। চাই না, আমার প্রচারও হোক। আমি শুধু চাই ইংরেজির প্রতি ভয় ভাঙুক পড়ুয়াদের। ওটা করতে পারলেই আমার কাজ শেষ!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy