গাড়ির ছাদ দুমড়ে ভিতরে ঢুকে এসেছে। গায়ে অসংখ্য ঘষা লাগার দাগ। খুলে বেরিয়ে গিয়েছে চাকার অংশও! গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন তো বটেই, কোনও জানলার কাচ আর অবশিষ্ট নেই। পিছনের অংশটিও এমন ভাবে দুমড়ে আসনের নীচে ঢুকে এসেছে যে, দেখে মনে হচ্ছে, পিছন থেকে কিছু সজোরে ধাক্কা মেরেছে। পুলিশ জানিয়েছে, প্রমোদভ্রমণ বা ‘জয় রাইড’-এ বেরিয়ে গার্ডেনরিচ উড়ালপুলে গতির তুফান তুলতে গিয়ে পথ-বিভাজিকায় ধাক্কা মেরে উল্টে যায় গাড়িটি। কয়েক বার উল্টেপাল্টে গিয়ে থামে। শুক্রবার রাতের এই দুর্ঘটনায় শুভম দাস (১৭) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। সে এ বছর মাধ্যমিক দিয়েছিল। গ্রেফতার করা হয়েছে গাড়িচালক রোহিত আগরওয়াল (১৯) নামে এক তরুণকে।
পুলিশ সূত্রের খবর, পাহাড়পুর রোডের রায়পাড়ার বাসিন্দা শুভমের সঙ্গে গাড়িতে ছিল তার প্রতিবেশী আরও পাঁচ কিশোর ও তরুণ। তাদের সকলেরই বয়স ১৭-২১ বছর। গাড়ি চালাচ্ছিল রোহিত। রাতে প্রমোদভ্রমণে বেরিয়ে হরিশ মুখার্জি রোডের দিকে একটি ধাবায় খেতে যাচ্ছিল তারা। শুভম চালকের পাশের আসনে বসলেও সিট বেল্ট বাঁধেনি। রাত ১০টা ১০ মিনিট নাগাদ ওই দুর্ঘটনা ঘটে। শুভমের মৃত্যু হলেও গাড়িতে থাকা বাকিদের চিকিৎসার পরে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ধৃত গাড়িচালকের কাছে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছিল না। ঘটনাস্থল দক্ষিণ বন্দর থানার অন্তর্গত হওয়ায় সেখানে রোহিতের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার (বিএনএস) বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি চালানো, অবহেলার কারণে মৃত্যু ঘটানো, আঘাত করা এবং সম্পত্তি নষ্ট-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে।
শনিবার গার্ডেনরিচে শুভমের পাড়ায় পৌঁছে জানা যায়, ওই গাড়িতে শুভম ও রোহিত ছাড়াও ছিল রিও সরকার, জয় দাস, সায়ন দাস এবং সূর্য প্রধান। তারা ওই পাড়ারই বাসিন্দা। শুভমের বাবা মদন দাস ছোটখাটো কাজ করেন। মা ঝর্না গৃহবধূ। বোন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। এ দিন শুভমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়েছেন। অঝোরে কেঁদে চলেছে শুভমের এক বন্ধু। পাশে বসে কাঁদছেন শুভমের মা-বাবা। কোনও মতে মা বললেন, ‘‘রোজ আমাকে বলে বেরোত। কাল বলে যায়নি। আর যে ফিরবে না, জানতাম না।’’ শুভমের বাবা বলেন, ‘‘পরিবারের পাশে দাঁড়াতে এই বয়সেই কেটারিংয়ের কাজে ঢুকেছিল। আমাদের সব শেষ হয়ে গেল।’’
শুভমের বাড়ির কাছেই রোহিতদের তেতলা বাড়িটি এ দিন তালাবন্ধ ছিল। এক প্রতিবেশী জানান, রোহিতের বাবা বড় ব্যবসায়ী। এলাকার প্রভাবশালীদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। রোহিতের একাধিক মোটরবাইক থাকলেও সে যে গাড়ি কিনেছে, তা কেউ জানতেন না। এক প্রতিবেশী বলেন, ‘‘গত কাল রাতে আমার দোকানের সামনে কালো গাড়িটা এসে দাঁড়ায়। দেখি, ভিতরে পাড়ার ছেলেরা রয়েছে। এখন নতুন ব্যাপার হয়েছে, রাতে চা খেতে যাওয়া। সেই কারণেই নাকি বেরিয়েছিল। কিন্তু গাড়ি রোহিত চালাচ্ছে দেখে অবাক হই, কারণ ও গাড়ি চালাতে পারে, সেটাই জানতাম না!’’
প্রতিবেশীদের আরও দাবি, পুলিশ জানিয়েছে, গার্ডেনরিচ থেকে বেরিয়ে উড়ালপুলে উঠে দ্রুত গতিতে গাড়ি ছোটায় রোহিত। ফলে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পথ-বিভাজিকায় ধাক্কা মেরে গাড়ি উল্টে যায় এবং কিছুটা দূরে গিয়ে থামে। সিট বেল্ট না পরায় শুভম গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে বেরিয়ে যায়। এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে গেলে শুভমকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
বন্দর ডিভিশনের পুলিশ সূত্রের খবর, থানার পাশাপাশি তদন্তে নেমেছে কলকাতা পুলিশের ফেটাল স্কোয়াড। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, গাড়িটির গতি অত্যন্ত বেশি ছিল। ভিতরে তারস্বরে বক্সও বাজানো হচ্ছিল। গাড়িটির মালিক কে এবং সেটির হাতবদল হয়েছিল কিনা, তা খোঁজ করা হচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জেনেছে, বাইকের লাইসেন্সের জোরেই স্টিয়ারিংয়ে বসে বিপদ ঘটিয়েছে রোহিত।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)