যতনে: কর্নাটকি স্থাপত্যে তৈরি সেই বিষ্ণুমন্দির। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা থেকে রাজঘাট আর মহীশূর উদ্যানের দূরত্ব কত? খুব বেশি ৪৫ মিনিট। অথচ কেওড়াতলা শ্মশানের মাঝে, আদিগঙ্গার পূর্বে এই রাজঘাট ও উদ্যানের অবস্থানের কথা হাতে গোনা মানুষ জানেন। ১২৫ বছর আগে নৌ-পথে বাণিজ্য চলত আদিগঙ্গা দিয়ে। তখনই ওই জলপথের ধারে মাথা তুলেছিল এক টুকরো মহীশূর। সে পথ গুরুত্ব হারিয়েছে বহুকাল। রাজঘাটের আলাদা অস্তিত্ব আর নেই৷ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে উদ্যান।
১৮৯৪ সাল। তখন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড এলগিন। কলকাতায় জরুরি কাজে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন মহীশূরের মহারাজা চামরাজেন্দ্র ওয়াদিয়ার। তারিখটা ছিল ২১ কিংবা ২২ ডিসেম্বর। ম্যাডাম মঙ্কের চৌরঙ্গির হোটেলে উঠেছিলেন মহারাজা। সে সময়ে থিয়েটার রয়্যালের দু’ধারে মঙ্কের দু’টি হোটেল ছিল। পরবর্তীকালে এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী ওই দু’টি হোটেল এবং থিয়েটার রয়্যাল কিনে সেগুলি ভেঙে তৈরি করেন আজকের গ্র্যান্ড হোটেল। এ শহরেই ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর ৩৩ বছর বয়সে মারা যান চামরাজেন্দ্র। এর বছর তিরিশেক আগে কালীঘাট মন্দির সংলগ্ন আজকের তর্পণ ঘাট থেকে শ্মশান সরে গিয়ে তৈরি হয়েছিল কেওড়াতলা। কিন্তু মহারাজা বলে কথা। তাই তাঁর দাহকার্যের জন্য কিনে নেওয়া হল কেওড়াতলা শ্মশানের পাশের অনেকটা জায়গা। সেখানে রাতারাতি তৈরি হয়ে গেল রাজার ঘাট, লোকমুখে যা রাজঘাট এবং ফুল-ফলে সাজানো বাগানের এক প্রান্তে তৈরি হল বিষ্ণুমন্দির। পুরোটা দেখভাল করত মহীশূর রাজ পরিবার। আশির দশকে রাজ পরিবার উদ্যানের দায়িত্ব হস্তান্তর করে কলকাতা পুরসভাকে।
কে এই চামরাজেন্দ্র ওয়াদিয়ার? মহীশূরের নারীশিক্ষা এবং শিল্পের প্রসারে উদ্যোগী ছিলেন তিনি। তার থেকেও বড় পরিচয় তিনি স্বামী বিবেকানন্দের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। ১৮৯৩ সালে তাঁর শিকাগো যাত্রার খরচ অনেকটাই চামরাজেন্দ্র বহন করেছিলেন।
মন্দিরের ভিতরের বিগ্রহ। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
চুন-সুরকি আর বেলেপাথর দিয়ে কর্নাটকি স্থাপত্যে তৈরি এই মন্দির এবং তোরণ। সে রাজ্যের হাসান জেলার হালেবিদ এবং বেলুড়ের মন্দিরকে মনে করিয়ে দেয় এটি। লতাপাতা, ফুল, মুখোশের কারুকার্য ভরা মন্দিরের উপরের দিকে কষ্টি পাথরে তৈরি বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার এবং বাহন গরুড়ের মূর্তি রয়েছে। ভিতরে কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ এবং আরও তিন অবতার সেখানে পূজিত। প্রবেশপথের তোরণের মাঝে এবং দু’ধারে রয়েছে একাধিক কষ্টিপাথরের মূর্তি। মন্দিরের চূড়ার সোনার ঘট অনেক বছর আগেই রাজ পরিবারের তরফে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিষ্ণুমন্দিরের গা ঘেঁষে রয়েছে ত্রিপুরার মহারাজার তৈরি ছোট্ট শিবমন্দির।
৭৪ বছরের পুরনো বাসিন্দা বিশ্বব্রত ব্রহ্মের স্মৃতিচারণে উঠে এল সেই সময়। তাঁর শৈশবে প্রতি বছর মহীশূরের রানি আসতেন মন্দির দর্শনে। মন্দিরের গা ঘেঁষে আদিগঙ্গায় রাজার ঘাট। উদ্যান চত্বরে সপরিবার থাকতেন পুরোহিত, মালি এবং পলি তোলার কাজের জন্য গঙ্গারাম। এঁদের মাইনে দিত রাজ পরিবার। পুরোহিতের মৃত্যুর পর থেকে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল মন্দিরটি। ধীরে ধীরে এলাকা আগাছায় ভরে যায়। অসামাজিক কাজও হত সেখানে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ওখানে শুয়োর পালন হত।
মন্দির তৈরির শতবর্ষ, ১৯৯৫ সালে স্থানীয় কাউন্সিলর মালা রায়ের উদ্যোগেই কলকাতা পুরসভা সংস্কারে হাত দেয়। মুর্শিদাবাদের একদল কারিগর মন্দিরের পুরনো ছবি দেখে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার করেন হারাতে বসা কারুকার্যের। সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে রাজঘাটের দিকে উঁচু প্রাচীর তুলে দেওয়া হয়েছে বহু আগেই। প্রতিদিন সকাল ৬-১টা এবং বিকেল ৩-৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে উদ্যান।
মৃত্যুর ১২৫ বছর পরেও ভাষা ও ভৌগোলিক সীমানার বাধা পেরিয়ে এক রাজার স্মৃতি ধরে রেখেছে এই উদ্যান। অথচ সংস্কারের পরেও কোথাও লিখিত আকারে ঠাঁই পায়নি সেই ইতিহাস!
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy