Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
১৮৯৫ সালে সমকামিতায় দণ্ডিত হন অস্কার ওয়াইল্ড। এখন সমকামিতা অপরাধ নয়। তবু ভ্যালেনটাইন্স ডে-র আবহে সংশয়, অস্কারের সময়ের সঙ্গে সমসময় একই রেখায় দাঁড়িয়ে নেই তো?
Homosexuality

‘৪১ শতাংশ ভারতীয়ই তাঁদের প্রতিবেশী হিসেবে কোনও সমকামীকে চান না’

শুধুমাত্র সমকামী হওয়ার জন্য অস্কারের মতো ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলমধারীকে সামাজিক লাঞ্ছনা, টিটকিরি, উপেক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল!

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:১২
Share: Save:

‘শরীর খুব খারাপ। প্লিজ় তাড়াতাড়ি এসো।’—রোবি রসকে টেলিগ্রাম করলেন অস্কার ওয়াইল্ড। তখন অক্টোবর মাস, ১৯০০ সাল। উদ্‌ভ্রান্তের মতো, কপর্দকশূন্য অবস্থায় কখনও ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখনও হোটেলেই থাকছেন। জেলে থাকা অবস্থায় শরীরের যে অবনতি হয়েছিল, তা আর ঠিক হয়নি। ১৮৯৭ সালের মে মাসে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। কিন্তু অসম্মান, সর্বস্ব হারানোর পরে ইংল্যান্ডে আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না তাঁর। তাই ফ্রান্সে পাড়ি দিয়েছিলেন।

ভাবা যায়, শুধুমাত্র সমকামী হওয়ার জন্য অস্কারের মতো ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলমধারীকে সামাজিক লাঞ্ছনা, টিটকিরি, উপেক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল! অথচ নাট্যব্যক্তিত্ব-সমালোচক তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দ লাল বলছেন, ‘‘নাটকের ‘কমেডি অব ম্যানার্স’ ধারার পথিকৃৎ ছিলেন অস্কারই। যেখানে তথাকথিত ‘এলিট’ বা অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তঃসারশূন্য সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে থেকে নির্মল হাসির উপাদান খুঁজে বের করতেন অস্কার। তার পরে তা বিলিয়ে দিতেন সাধারণ দর্শক-পাঠকের মধ্যে।’’

কিন্তু তখন আর কে সে সব শুনছে! পরিস্থিতি এমন যে, ফ্রান্সে গিয়েও লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকছেন অস্কার। জেলখানার স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। বন্দিরা কী দুর্বিষহ অবস্থায় জেলে থাকেন, সে প্রসঙ্গে ‘ডেইলি ক্রনিকল’-এ চিঠি লিখলেন। আবার জেলখানার স্মৃতির উপরে ভিত্তি করে লিখে ফেললেন, ‘দ্য ব্যালাড অব রিডিং জেল’। যদিও সে লেখা নিজের নামে ছাপতে রাজি হননি অস্কার। প্রকাশককে বলেছিলেন, ‘‘আমার নামে না ছাপানোই ভাল।’’ কারণ,—‘‘আই সি ইট ইজ মাই নেম দ্যাট টেরিফাইস!’’ ১৮৯৮ সালে লেখাটি প্রকাশিত হল। অস্কার ওয়াইল্ডের নামের পরিবর্তে লেখকের নামের জায়গায় লেখা থাকল সি.৩.৩। রিডিং জেলখানায় থাকাকালীন সেটাই ছিল তাঁর পরিচয়! কবিতাটি প্রকাশিত হওয়া মাত্রই তা তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল।

কিন্তু সেই প্রকাশের ১২৩ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে, সমকামী, রূপান্তরকামীদের নিয়ে সামাজিক মানসিকতার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। ৩৭৭ ধারাকে ‘ডি-ক্রিমিনালাইজ’ করার জন্য যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তার প্রতিষ্ঠাতা তথা এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর অঞ্জলি গোপালন বলছেন, ‘‘আইনের পরিবর্তন হলেও প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার থেকে এলজিবিটি সম্প্রদায় এখনও ব্রাত্য।’’ বরং এ দেশে জনসংখ্যার একটা অংশ এলজিবিটি-দের নিয়ে ‘হোমোফোবিয়া’-য় ভোগেন বলে জানাচ্ছে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষা। মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র অধ্যাপক প্রশান্তকুমার রায় বলছেন, ‘‘হোমোফোবিয়া হল সমকামী, রূপান্তরকামীদের এড়িয়ে চলার মানসিকতা।’’

বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষাতেও তারই প্রতিফলন ধরা পড়েছে। এক গবেষকের কথায়, ‘‘ওই সমীক্ষা বলছে, ৪১ শতাংশ ভারতীয়ই তাঁদের প্রতিবেশী হিসেবে কোনও সমকামীকে চান না! ৬৪ শতাংশ ভারতীয় আবার কোনও ভাবেই সমকামকে সমর্থন করেন না।’’ এ প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ করছেন অনেকে। তা হল, তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর যাঁরা অফিসে বা সমস্তরের কোনও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তাঁদের ৫৬ শতাংশই ‘সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন’-এর কারণে নানা ভাবে হেনস্থা ও বৈষম্যের শিকার হন! তাই ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রান্সজেন্ডার/হিজড়ে ইন বেঙ্গল’-এর কর্ণধার রঞ্জিতা সিংহ বলছেন, ‘‘প্রতিটি ক্ষেত্রে কী মানসিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়, সেটা একমাত্র আমরাই বুঝি।’’

যেমনটা বুঝেছিলেন অস্কার। শারীরিক, মানসিক অবস্থা, আর্থিক বিপর্যয়—সব মিলিয়ে আর ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তাঁর। লেখার ইচ্ছেটুকুও চলে গিয়েছিল। তত দিনে সেরিব্রাল মেনিনজাইটিস ধরা পড়েছে। মৃত্যু অবধারিত। শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত, বৈচিত্রময়, ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী লেখনীর জীবন থেমে গেল ১৯০০ সালের নভেম্বরে। প্যারিসেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁকে।

আর বোসি?

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে বোসির সঙ্গে দেখা করেছিলেন অস্কার। নিজের জীবনের দীর্ঘতম চিঠি, ‘ডে প্রোফোন্ডিস’-এর তিক্ততা ভুলে! তবে বেশি দিন নয়। দু’জনেরই পরিবার মাসোহারা বন্ধের হুমকি দেওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন যুগল। কিন্তু এত কিছুর পরেও বোসির কাছে কেন ফিরে গিয়েছিলেন অস্কার?—হয়তো অস্কার বুঝেছিলেন, ঘৃণার দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবেন না তিনি। আসলে এ যেন এক অগ্নিদগ্ধ প্রণয়কথা! তাই যাবতীয় সামাজিক রক্তচক্ষু, পরস্পরের প্রতি ভুল বোঝাবুঝি, অপমানকে দূরে রেখে এক অমোঘ টানে পরস্পরের চারিদিকে ঘুরে বেড়িয়েছেন অস্কার-বোসি। বোসির প্রতি ছত্রে-ছত্রে ঘৃণার পাশাপাশি অস্কার এটাও বুঝেছিলেন, তিনি অসহায় ভাবে ভালবাসেন বোসিকে। তাই লিখেছিলেন, ‘যদি আমি অপেক্ষা না করে তোমার জন্য দরজা বন্ধ করে দিই, তবু তুমি জেনো কেউই প্রেমের দরজা বন্ধ রাখতে পারে না আজীবন। আমি হয়তো সেই জন যে তোমাকে আরও কিছু বিস্ময়কর মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য বা বিষণ্ণতার সৌন্দর্য শেখানোর জন্য নির্বাচিত হয়েছি।

—তোমার প্রিয় বন্ধু, অস্কার ওয়াইল্ড’!

(শেষ)

অন্য বিষয়গুলি:

Homosexuality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy