৪ ডিসেম্বর ১৯৬১, কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে ইউরি গাগারিন
২০০৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা বর্ষ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। কারণ, ওই বছরটা ছিল কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কারের শতবর্ষ। সেই সব আবিষ্কারের নায়ক এক জনই। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে পাঁচখানা পেপার লিখে ফিজ়িক্সে নবযুগের সূচনা করেছিলেন আইনস্টাইন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ২৬। চাকরি করেন সুইৎজ়ারল্যান্ডে বার্ন শহরে পেটেন্ট অফিসে। সামান্য কেরানি তিনি।
তা-ও প্রতিভার এত স্ফুরণ দেখে চমৎকৃত হতে হয়।
বিজ্ঞানের জার্নালে ছাপা হল ওই পাঁচটি পেপার। পড়লেন কতিপয় বিজ্ঞানী। অজ্ঞাতকুলশীল আইনস্টাইনের নাম কিন্তু তখন ছড়াল না। ছড়াল কবে? কবে তিনি হলেন আইকন— বিজ্ঞানীকুলে শ্রেষ্ঠ সেলেব্রিটি? ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে। এক এক্সপেরিমেন্টের খবর মিডিয়ায় প্রচারের সুবাদে। তখন রেডিয়ো থাকলেও টেলিভিশন ছিল না। কোথাকার কোন এক্সপেরিমেন্টের খবর, তা রেডিয়ো প্রচার করবে কোন দুঃখে? বিজ্ঞান জগতের খবরাখবর প্রচারের জন্য তখন মুদ্রণমাধ্যমই ভরসা। সে মাধ্যমের কত ক্ষমতা, তা বোঝা যায় আইনস্টাইনের খ্যাতির উৎস জানলে।
তাঁর আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় তত্ত্ব হল জেনারেল রিলেটিভিটি, যা আইজ়্যাক নিউটনের আবিষ্কৃত গ্র্যাভিটির সংশোধিত রূপ। নিউটন বলেছিলেন, গ্র্যাভিটি হল বস্তুতে বস্তুতে আকর্ষণ। আইনস্টাইন বললেন, গ্র্যাভিটি টানাটানি নয়, স্রেফ স্পেস-টাইমের জ্যামিতি। ভর তার চার পাশের শূন্যস্থান দুমড়ে মুচড়ে দেয়। ফলে, হালকা বস্তু ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যেতে গেলে ওই দোমড়ানো শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে চলার সময় তার পথ বেঁকে যায়।
কার তত্ত্ব ঠিক? টানাটানি না স্পেসের দোমড়ানো অবস্থা? পরীক্ষা হবে। কী ভাবে? পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের কালে। তখন চাঁদের ছায়ায় সূর্য ঢাকা পড়ে যায়। দিনের বেলায় আকাশে তারা দেখা যায়। মানে, তারার আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছয়। তারার আলো আসার সময় সূর্যের পাশ ঘেঁষে আসে। সূর্য ভারী। তা চার পাশের স্পেসকে দোমড়াবে। তারার আলো পৃথিবীতে আসার সময় তার পথ বাঁকবে। নিউটনের তত্ত্বেও বাঁকবে, কারণ আলো হল কণার সমষ্টি, কণার ভর আছে বলে সূর্য তাকেও আকর্ষণ করবে। সেই আকর্ষণের জন্য তারার আলোর পথ যতটা বাঁকবে, স্পেসের দোমড়ানোর দরুন বাঁকবে তার দ্বিগুণ।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। দুই ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন এবং ফ্র্যাঙ্ক ওয়াটসন ডাইসন তারার আলোর বাঁক মাপজোক করার জন্য ছুটলেন পৃথিবীর দুই প্রান্তে। পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে সময় লাগল। ১৯১৯ সালের ৬ নভেম্বর তা পেশ করা হল দ্য রয়্যাল সোসাইটি এবং দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির যৌথ সভায়। দেখা গেল, আলো বেঁকেছে দ্বিগুণ। অর্থাৎ আইনস্টাইন ঠিক, নিউটন ভুল।
বাকিটা মিডিয়ার কৃপা। ৭ নভেম্বর ১৯১৯। লন্ডনের দ্য টাইমস কাগজ ওই খবর কভার করে হেডলাইন ছাপল: ‘বিজ্ঞানে বিপ্লব/ ব্রহ্মাণ্ডের নতুন তত্ত্ব/ নিউটনের ধারণা ছুড়ে ফেলা হল’। অতলান্তিকের ও-পারে আর এক বিখ্যাত খবরের কাগজ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। তার কোনও বিজ্ঞান সাংবাদিক নেই লন্ডনে, আছে এক গল্ফ করেসপনডেন্ট। হেনরি ক্রাউচ। তিনি ঢোকার অনুমতি পেলেন না রয়্যাল সোসাইটি আর রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির যৌথ সভায়। পর দিন ক্রাউচ কাগজ দেখে থ! এডিংটনকে ধরলেন। তিনি খবর এবং তাৎপর্য বোঝালেন ক্রাউচকে। ৮ নভেম্বর ১৯১৯। ছয় লাইনের হেডিং বেরোলো দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ। ‘‘স্বর্গে আলো তির্যক/ বিজ্ঞানীরা যখন পর্যবেক্ষণে মোটামুটি উত্তেজিত/ আইনস্টাইন-তত্ত্বের জয়/ নক্ষত্রেরা সেখানে নেই, গণনায় তাদের যেখানে থাকার কথা ছিল, তবুও উদ্বেগের কারণ নেই/ জ্ঞানীরাই কেবল তাৎপর্য বুঝবেন/ সাহসী প্রকাশক ছাপাতে চাইলে আইনস্টাইন বললেন, কেউ বুঝবেন না।’’
ব্যস, দুই জবরদস্ত কাগজে প্রথম পাতায় ও-রকম হেডলাইনে আইনস্টাইন রাতারাতি বিখ্যাত! কে বলল, মিডিয়া সেলেব তৈরি করে না? বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদেরা বার বার স্মরণ করেন অতলান্তিকের দুই পারের ওই দুটো হেডলাইনের কথা।
বাংলা আন্তর্জাতিক ভাষা হলে আনন্দবাজার পত্রিকা-র নামও সোনার অক্ষরে লেখা হত বিজ্ঞানের খবর পরিবেশন করার জন্য। খবর যে বিজ্ঞানের দুনিয়া থেকেও হতে পারে, তা আনন্দবাজার জন্মলগ্ন থেকে মনে করেছে— রীতিমতো উৎসাহের সঙ্গে বিজ্ঞানের খবর পরিবেশন করেছে। বাংলা মুদ্রণমাধ্যমে আনন্দবাজার অনেক দিকের মতো এ বিষয়েও ভগীরথ। অন্য কাগজ তার অনুসারী মাত্র।
বাংলা সাংবাদিকতায় উত্তমকুমার যদি হন বরুণ সেনগুপ্ত, তা হলে সত্যজিৎ রায় অবশ্যই সন্তোষকুমার ঘোষ। তাঁর হাতেই বাংলা সাংবাদিকতায় তাবৎ আধুনিকতার আমদানি। সাধু ভাষার হোঁচটের পরিবর্তে তরতর করে এগোনোর মতো প্রাঞ্জল চলিত ভাষায় হেডিং এবং খবর লেখাই তাঁর একমাত্র কৃতিত্ব নয়। তাঁর নেতৃত্বে আনন্দবাজার বিষয়বৈচিত্রেও হয়ে উঠেছিল অনন্য। কেবল রাজনীতি যে সংবাদপত্রের একমাত্র বিষয় হতে পারে না, তা শিক্ষিত এবং প্রতীচ্যমুখী সন্তোষকুমার বুঝেছিলেন। বিজ্ঞানজগতের খবরেও যে পাঠকেরা উৎসুক হবেন, তা তাঁর বুঝতে অসুবিধে হয়নি।
আদ্যন্ত রবীন্দ্রানুরাগী এই মানুষটি মাঝে মাঝেই তাঁর নৈপুণ্য দেখাতেন অবিস্মরণীয় হেডিং রচনা করে। পাঠক যে হেডিং দেখে খবর পড়তে আগ্রহী হয়, তা সন্তোষকুমার ভাল জানতেন। ১২ এপ্রিল ১৯৬১। রুশ নভশ্চর ইউরি আলেক্সিভিচ গাগারিন মহাকাশে গেলেন। মনুষ্যকুলে প্রথম। তা যে কত বড় ঘটনা, পর দিন টের পেলেন আনন্দবাজারের পাঠক। প্রথম পৃষ্ঠায় ছয় কলাম জুড়ে হেডিং: ‘মানুষ চূর্ণিল আজ নিজ মর্ত্যসীমা’। এর চেয়ে কবিত্বময় আর কোনও হেডলাইন সম্ভব? প্রথম পাতায় মহাকাশযাত্রা নিয়ে কত খবর! প্রায় পুরো পৃষ্ঠা জুড়েই। কী কী সব হেডলাইন! ‘মহাবিশ্বে, মহাকাশে প্রথম মানুষ’, ‘মানবিক বিজ্ঞান-বুদ্ধির বিজয় বৈজয়ন্তী’ ইত্যাদি। বিজ্ঞান গবেষণা যে প্রতিযোগিতার আর এক নাম, তা জানিয়ে দেয় আর একটি খবর: ‘মহাকাশ জয়ের পথে আমেরিকা/ পরিকল্পনা প্রকাশিত’। প্রতিক্রিয়া? কাদের জিজ্ঞাসা করবেন স্টাফ রিপোর্টার? সাধারণ মানুষ নয়, কলকাতার বিজ্ঞানী মহল। রিপোর্টার গেলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে। তাঁর মন্তব্য বিজ্ঞানীসুলভ। এক জন মানুষকে মহাকাশে পাঠিয়ে পৃথিবীর মাটিতে তাঁকে সশরীরে ফিরিয়ে আনতে প্রচুর গণনার প্রয়োজন। গাগারিনের মহাকাশ অভিযান যদি কিছু প্রমাণ করে থাকে, তবে তা হল ওই গণনায় রুশ গবেষকেরা সফল। সত্যেন্দ্রনাথের মন্তব্যও দেখছি প্রথম পৃষ্ঠায়।
আর এক সপ্তাহ। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাস। ভারতে রাজনীতিতে সে এক টালমাটাল সময়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ১৪টি ব্যাঙ্ককে জাতীয় সম্পত্তি ঘোষণা করলেন। কংগ্রেস দল দু’ভাগ হচ্ছে। এই সময় মানুষের চন্দ্রবিজয়। আনন্দবাজারের প্রথম পৃষ্ঠায় হেডলাইন: ‘অ্যাপোলো-১১ এখন চাঁদের কক্ষপথে’। খবরের মাঝখানে বোল্ড টাইপে বক্স করে ঘোষণা— ২২ জুলাই ১৯৬৯ তারিখে আনন্দবাজার বার করতে চলেছে ‘চন্দ্র ক্রোড়পত্র’। ঘোষণায় বলা হল, “মানবেতিহাসে এই প্রথম মানুষ চাঁদে নামতে চলেছে। এ উপলক্ষে মঙ্গলবার আনন্দবাজার পত্রিকার নিয়মিত সংখ্যার সঙ্গে অতিরিক্ত একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে।”
২১ জুলাই ১৯৬৯। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম পাতায় পাঁচ কলাম জুড়ে হেডলাইন: ‘মানুষ চন্দ্রলোকে উত্তীর্ণ’। তার পরের লাইনে একটু ছোট পয়েন্টে ‘আজ ভেলা থেকে নভোচারীদের পদক্ষেপ’। খবর শুরু তার পর। প্রথম কয়েক পরিচ্ছেদ এ রকম: “চাঁদে মানুষ। ঠিক এ মুহূর্তে পৃথিবীর দুটি মানুষ চাঁদের উপকূলে ভেলা ভিড়িয়ে নামার প্রতীক্ষায় রয়েছেন। যুগের পর যুগ ধরে চাঁদ মানুষকে ডেকেছে, মহাকাশের বিপুল শূন্যতায় পৃথিবীর চিরসঙ্গী সে চাঁদের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেবার জন্য পৃথিবীর দুটি মানুষ সেখানে উপস্থিত।
এক অভিকর্ষের মাতৃবন্ধন ছিন্ন করে অন্য এক অভিকর্ষে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, চাঁদের বন্দরে ‘ভেলা’ থামিয়ে প্রতীক্ষা করছে।
বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এবং সর্বোপরি চিরন্তন অভিযান-পিপাসা মানুষকে আজ এক পৃথিবীর প্রান্তর থেকে মহাকাশের অপর এক পৃথিবীর অজানা সমুদ্র-তটে নিয়ে গিয়েছে। ভাবীকালে কোনও একদিন মানুষ সে সমুদ্র-তট থেকে তরী ভাসিয়ে দেবে আরও দূরে, সময় সমুদ্রের ওপারে, বহু আলোকবর্ষ দূরে, যেখানে নতুন সূর্য জন্ম নিচ্ছে, অথবা অজানা সূর্যের অজানা কোনও গ্রহে, যেখানে জীবন-লীলা সবেমাত্র শুরু হয়েছে—।”
পরের দিন। ২২ জুলাই, ১৯৬৯। আনন্দবাজার পত্রিকার মাস্টহেড নেমে এসেছে বাঁ দিকে। মাস্টহেডের জায়গা দখল করেছে হেডিং— ‘সবার উপরে মানুষ’। তার নীচে আর এক হেডলাইন, এ বার সবচেয়ে বড় পয়েন্টে— ‘চন্দ্র পদতলে’।
সন্তোষকুমারের দুই হেডিং বুঝিয়ে দিচ্ছে ঘটনার অভিঘাত। মানুষ কী না পারে? চাঁদের বুকে এঁকে দিতে পারে তার পায়ের চিহ্ন।
শুনেছি, এ দিন প্রথম পাতার খবর লেখার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সমরজিৎ কর। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বিখ্যাত বিজ্ঞান সংবাদদাতা ওয়াল্টার সুলিভান-এর এই ছাত্র দেশ পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে বিজ্ঞানের কলাম লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। বিজ্ঞানের দুরূহ বিষয়গুলো প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতে পারতেন। দেশ পত্রিকায় অবশ্যপাঠ্য ছিল ওঁর কলাম। সমরজিৎদার কাছে শুনেছি, এক-একটা পাতা করে উনি লিখে দিচ্ছেন, আর বেয়ারা সে লেখা কম্পোজ়িটরের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। সমরজিৎদার সামনে বসে আছেন গৌরকিশোর ঘোষ, অমিতাভ চৌধুরী প্রমুখ। সমরজিৎদা লিখছেন, “চাঁদ পরিক্রমা শেষ করে পৃথিবীর দুটি মানুষ এখন আবার পৃথিবীতে ফেরার পথে। ২১ জুলাই, সোমবার সকাল ৮টা ২৬ মিঃ ২০ সেকেন্ড মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভাস্বর দিন ও ক্ষণ! এই দিনটিতে মানুষ জ্যোতিষ্কমণ্ডলের আর এক সহযাত্রীর বুকে পদচিহ্ন রেখে এসেছে— পৃথিবীর যুগ যুগান্ত অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও কোনও দিন হয়তো এই চিহ্ন মুছে যাবে না। চাঁদ অনন্তকাল এই চিহ্ন বুকে নিয়ে জেগে থাকবে।”
সাহসী সাংবাদিকতার লক্ষণ যদি হয় বিতর্ক সৃষ্টি, তা হলে তাতেও সন্তোষকুমার ছিলেন সিদ্ধহস্ত। লোকে এ ব্যাপারে শুধু মনে রাখে নতুন আঙ্গিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া নিয়ে সন্তোষকুমার-দেবব্রত বিশ্বাস কাজিয়া। এ কথা আজ বিস্মৃত যে, তিনি একদা এক প্রশ্ন উত্থাপন করে ভারতীয় বিজ্ঞান জগতে বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন। এসরাজ বাজাতে বহু সময় খরচ করে সত্যেন্দ্রনাথ বসু কি নিজের মেধার সুবিচার করতে ভুলে গিয়েছেন!
বিজ্ঞানে নানা বিষয়ে প্রবন্ধ ছাপানোয় আনন্দবাজার অগ্রণী। কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। ৩০ নভেম্বর, ১৯৫৮ জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মশতবর্ষ। আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশ করল বিশেষ ক্রোড়পত্র, ‘বিজ্ঞান-তাপস জগদীশচন্দ্র: আবির্ভাব শতবার্ষিকী’। প্রথম পাতায় শান্তিনিকেতন থেকে জগদীশচন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, জগদীশের লেখা পুরস্কৃত ছোটগল্প ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’, ১৯২৮ সালে তাঁকে লেখা ফরাসি মনীষী রম্যাঁ রলাঁ-র শ্রদ্ধার্ঘ্য। মূল রচনা অবশ্যই জগদীশচন্দ্রের রেডিয়ো আবিষ্কার। লেখক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য।
আর এক বিজ্ঞানলেখক অরূপরতন ভট্টাচার্য। ‘রবিবাসরীয়’তে সপ্তাহের পর সপ্তাহ সিরিজ় লিখেছিলেন: ‘আমরা কেন আমাদের মতো দেখতে’। জিনতত্ত্ব বুঝিয়ে। তখন সত্তরের দশক। ‘রবিবাসরীয়’-এর দায়িত্বে ছিলেন রমাপদচৌধুরী। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। সাহিত্যিক হলেও বিজ্ঞানে আগ্রহী। জনপ্রিয় বিজ্ঞানলেখক অরূপরতনকে ফরমাশ করেছিলেন বাঙালিকে জিনতত্ত্ব বোঝাতে। অরূপরতন বলেছিলেন, ‘রবিবাসরীয়’-এর জায়গায় কুলোবে না। রমাপদ বলেছিলেন, বেশ তো, আপনি সিরিজ় লিখুন। তাই লিখেছিলেন অরূপরতন। জনপ্রিয় সেই সিরিজ় পরে বই আকারে প্রকাশিত হলে বেস্টসেলার বনে যায়।
আর এক জনকে চিনেছিলেন রমাপদবাবু। তিনি বাইরের ফ্রিলান্সার নন। আনন্দবাজার পত্রিকার কর্মী। জগদ্বন্ধু ভট্টাচার্য। চিফ সাব-এডিটর। সাহিত্য মিশিয়ে বিজ্ঞান লিখতে পারতেন। সাহিত্যিক রমাপদ এই কারণে পছন্দ করেছিলেন সহকর্মীকে। আইনস্টাইনের রিলেটেভিটি নিয়ে বই লিখেছিলেন জগদ্বন্ধু। ‘মহাকাশ ও মহাকাল’। শর্টলিস্টেড হলেও সে বই পায়নি রবীন্দ্র পুরস্কার। স্বীকৃতির ব্যাপারে বাঙালি কৃপণ। আমার প্রিয় বিজ্ঞান লেখক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ডেনিস ওভারবি। ওঁর লেখা পড়লে জগদ্বন্ধুর কথা মনে পড়ে। কলাম লেখেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে জগদ্বন্ধু বলেছিলেন, নিয়মিত লেখার চাপ সহ্য করতে পারি না। লিখতেন কম। এক-এক বিষয়ে মনকে জারিত করতে সময় নিতেন হয়তো। সে জন্য এক-একটা প্রবন্ধ মণিমুক্তোর মতো।
১৯৭৪ সালে ১৬ নভেম্বর। পুয়ের্তো রিকো-র আরিসিবো টেলিস্কোপ থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এক বার্তা পাঠালেন মেসিয়ার-১৩ নক্ষত্রপুঞ্জের উদ্দেশে। সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স (ইংরেজি আদ্যক্ষরে ‘সেটি’) বা ভিন্গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী খোঁজার ব্যাপারে ওই বার্তা এক মাইলস্টোন। সেটি-র ক্ষেত্রে বড় বাধা হল ভাষা। পৃথিবীতে কতশত ভাষা, এক ভাষায় কথা বললে অন্য মানুষ বোঝে না। দূরদূরান্তের গ্রহবাসী হলে তো কথাই নেই। সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ছাড়া তাদের কাছে আমাদের অস্তিত্ব জানান দিতে গেলে বুঝবে না। জানানো যায় কী ভাবে? আমরা ডিএনএ দিয়ে তৈরি, ডিএনএ আবার কোন কোন মৌল দিয়ে তৈরি, সে সব বুঝিয়ে। সে সব জানাতেই রেডিয়ো মেসেজ। মেসিয়ার-১৩ নক্ষত্রপুঞ্জে অনেক গ্রহ। তাদের কোনওটায় যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, তারা যদি পড়ে সে মেসেজ, আর উত্তর দেয় তার, তা হলে আমরা জানব দূরদূরান্তের গ্রহে বুদ্ধিমান জীব আছে। জগদ্বন্ধু আরিসিবো থেকে পাঠানো রেডিয়ো মেসেজ নিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন। ‘যে চিঠির উত্তর আসবে ৫০,০০০ বছর পরে’। কেন? মেসিয়ার-১৩ নক্ষত্রপুঞ্জ যে পৃথিবী থেকে ২৫,০০০ আলোকবর্ষ দূরে। রেডিয়ো মেসেজ ছুটবে আলোর স্পিডে। মানে, সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। সেই বেগে ছুটেও রেডিয়ো মেসেজের মেসিয়ার-১৩ নক্ষত্রপুঞ্জে পৌঁছতে লাগবে ২৫,০০০ বছর। মেসেজের উত্তর আসতে আরও ২৫,০০০ বছর। তাই চিঠির উত্তর পেতে ৫০,০০০ বছর!
জগদ্বন্ধুর অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ভারতীয় প্রেক্ষাপটে জিনিস ব্যাখ্যা করার। ১৯৭৫ সাল। কলকাতার সল্টলেকে তৈরি হয়েছে ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার (ভিইসিসি)। সাইক্লোট্রন হল কণায় কণায় ঠোকাঠুকি করার যন্ত্র। লক্ষ্যভেদে কতখানি পটু হলে তবে ছুটন্ত একটা কণা গিয়ে আঘাত করতে পারে আর একটা কণাকে? ভিইসিসি-র প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে জগদ্বন্ধু প্রবন্ধ লিখলেন আনন্দবাজারে: ‘সল্টলেকে গুরু দ্রোণাচার্যের সঙ্গে’।
পাঠকই প্রথম। আজ আনন্দবাজার পত্রিকার স্লোগান। পাঠকদের তরফে বহু দিন ধরেই দাবি ছিল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে সপ্তাহে একটা পৃষ্ঠা নিয়োজিত হোক। বিজ্ঞানের খবর তো কাগজ ছাপেই। ছাপে প্রবন্ধও। সে সব ছাড়াও নতুন একটা পাতা হোক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর ছাপার জন্য। অনেকগুলো নতুন বিভাগের (যেমন, ‘হাওয়া বদল’, ‘স্বস্তিপাঠ’ ইত্যাদি) সঙ্গে তাই ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে ‘এষণা’। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন দফতর। সন্তোষকুমার বা জগদ্বন্ধু দেখে গেলে খুশি হতেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy