(বাঁ দিকে) মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জুনিয়র ডাক্তার মনীষা ঘোষ (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
নীলের উপর সাদা ছাপা কুর্তি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। টেনে বাঁধা চুল। ‘লাইভ স্ট্রিমিং’-এ তাঁকে দেখা গিয়েছিল এক ঝলকই। মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে ছোট ছোট বাক্যে একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ব্যাখ্যাটি ছোট্ট। কিন্তু তার ব্যাপ্তি প্রসারিত। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, নবান্ন সভাঘরে বসে সেই ব্যাখ্যা তিনি দিচ্ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে। দৃঢ় এবং শান্ত কণ্ঠে সামান্য কয়েকটি বাক্যে তিনি মোটেও দ্বিধা করেননি মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাকরণের ভুল শুধরে দিতে। মুখ্যমন্ত্রী যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই ব্যাখ্যা মানেননি। তবে তার পর থেকেই জনমানসে প্রশ্ন, আলোচনা এবং তার চেয়েও বেশি কৌতূহল— কে এই জুনিয়র ডাক্তার?
সোমবার নবান্ন সভাঘরে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সব মিলিয়ে সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের ১৭ জন প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু বৈঠক সেরে তাঁরা নবান্ন থেকে বেরোনোর আগেই জনমানসের নজর কেড়ে ফেলেছেন বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার মনীষা ঘোষ। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সমর্থকেরা তো বটেই, ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ দেখতে থাকা মানুষজনও ‘বিস্মিত’ ওই জুনিয়র ডাক্তারের ব্যাখ্যায়। বিস্ময়ের কারণ? ধারে-ভারে-ক্ষমতায়-প্রভাবে অনেক উপরে থাকা একজন মুখ্যমন্ত্রীকে কেউ যে ও ভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারেন, তা অভাবিত! সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মনীষার ওই ব্যাখ্যার ভিডিয়ো। ছড়িয়ে যায় মিম। যেখানে মনীষা স্পষ্ট ভাবে জানাচ্ছেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাঁকে অভিযুক্ত বলা হয়। যত ক্ষণ না তিনি দোষী বা নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন, তত ক্ষণ তিনি অভিযুক্ত। অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে গেলে তিনি দোষী। ব্যাকরণ বা আইনের দিক থেকে এতে কোনও ভুল নেই।
মনীষা যখন নবান্ন সভাঘরে এই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তখন সেখানেও তৈরি হয় এক মুহূর্তের স্তব্ধতা। যদিও তিনি নিজে বা তাঁর বাকি ১৬ জন ‘সহযোদ্ধা’র কেউই জানতেন না, নবান্ন-বৈঠকের ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ হচ্ছে। মঙ্গলবার আনন্দবাজার অনলাইনকে মনীষা জানালেন, ‘লাইভ স্ট্রিমিং’-এর কথা যদি জানতেন, তা হলেও মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়া তাঁর ওই ব্যাখ্যা একই থাকত। বলতেনও একই রকম ভাবে। কারণ মনীষা মনে করেন, তাঁর বক্তব্য ব্যাকরণ বা আইনের দিক থেকে মোটেও ভুল নয়। এবং সে বিষয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী।
দমদমের বাসিন্দা মনীষার বাবা-মা কী করেন? পরিবারে কে কে আছেন? এ সব নিয়ে তিনি কিছুই বলতে চাননি। তবে মুখ্যমন্ত্রীকে ওই ব্যাখ্যা দেওয়া নিয়ে যে বাড়িতে কেউ তাঁকে বকাঝকা করেননি, সে কথা স্পষ্টই বলছেন মনীষা। পরিবারে কি কেউ আইনজীবী আছেন? মনীষার স্পষ্ট জবাব, ‘‘না।’’ এর পর তাঁর সংযোজন, ‘‘আমি সাধারণ জ্ঞান, যুক্তির দিক থেকে বলেছি। অত ভেবে বলিনি।’’ ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ হচ্ছে জানলে কি ওই কথাটা ও ভাবেই বলতে পারতেন? বছর চব্বিশের মনীষার কথায়, ‘‘ওটা জানলেও মনে হয় না আমার কথাবার্তায় কোনও প্রভাব পড়ত। তবে লাইভ স্ট্রিমিং যে হচ্ছে, সত্যিই জানতাম না। আমার মনে হয় না, ভুল করেছি। হলঘরে হলেও বলতাম, তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) একা থাকলেও বলতাম।’’
২০১৮ সালে বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়তে গিয়েছিলেন মনীষা। হস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করেছেন। এখন ওই কলেজে হাউসস্টাফশিপ করছেন। এখনও হস্টেলেই থাকেন। অবসর সময়ে কী করেন? মনীষা বললেন, ‘‘লেখালিখি। তবে নিজের জন্য। কোথাও প্রকাশ করার জন্য নয়। আগে বই পড়তাম। এখন সময় কমে আসায় তেমন পড়া হয় না।’’
মনীষার দেওয়া ব্যাখ্যা নিয়ে সমাজমাধ্যমে অনেক মিম ছড়িয়েছে। বেশির ভাগই মুখ্যমন্ত্রীর ‘জ্ঞান’কে কটাক্ষ করে। কোথাও আবার তারিফও করা হয়েছে মনীষার। এ সব শুনে একটু লজ্জাই পাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘সভাঘর থেকে বেরিয়ে যখন দেখলাম এত আলোচনা হচ্ছে, তখন লজ্জা লেগেছিল খুব। ওটা ভেবে বলেছিলাম এমন নয়, বলেই ফেলেছিলাম। আটকাতে পারিনি, কারণ আগের বৈঠক থেকে শুনে আসছি এ সব কথা।’’
আরজি কর-কাণ্ডের আবহে প্রশাসনের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের যতগুলি বৈঠক হয়েছে, সব ক’টিতেই ছিলেন মনীষা। শুধু নবান্নে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের সঙ্গে যে বৈঠক হয়, সেখানে যাননি তিনি। স্বাস্থ্য ভবনে মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকেও ছিলেন। তাঁর অভিযোগ, ওই বৈঠকেও স্বাস্থ্যসচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গেলে এ ভাবেই বাধা দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য ভবনের বৈঠকেও বলার চেষ্টা করেছিলাম মুখ্যসচিবকে। কিছুটা বলতেও পেরেছিলাম যে, কেন আমরা অভিযোগ করছি। সেখানে বলা হয়, সব প্রশ্নের উত্তর কি দিতে হবে? আমরা বলেছিলাম, কারণটুকু অন্তত বলুন। যত বার স্বাস্থ্যসচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি, দমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এটা বলতে পারবে না।’’
মনীষার দাবি, এর পর কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির বৈঠকেও তাঁদের এই অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে বাধা দেওয়া হয়। তাঁর অভিযোগ, সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার জন্য প্রবেশের সময় থেকে ‘বিরূপ’ মনোভাব দেখানো হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ওই জুনিয়র ডাক্তারের কথায়, ‘‘বিচারের দাবি লেখা ব্যাজ গেটের বাইরে খুলিয়ে আমাদের সভাঘরে প্রবেশ করানো হয়। বসার পর বৈঠকে বলা হয়, যাঁদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে, যাঁরা ভয়ের রাজনীতিতে যুক্ত, তাঁদের নাম নেওয়া যাবে না। তার পর স্বাস্থ্যসচিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি বহু বার তোলার চেষ্টা করেছি। দমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’
তাতেই কি জেদ চেপে গিয়েছিল? মনীষা বলেন, ‘‘এই বৈঠকেও যখন বলা হল, এটা বলা যাবে না, তখন মনে হল, নাহ্, এটা বলি। আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ব্যাকরণগত দিক থেকে যে ভুল নই, এটুকু জানতাম। কাল যে শরীরী ভাষা দেখা গিয়েছে প্রশাসনের, যাঁরা দেখেছেন স্ট্রিমিংয়ে, তাঁরা বুঝতে পারবেন স্পষ্ট। আমি সেখান থেকেই বলি যে, অভিযোগ থাকলে অভিযুক্ত বলা যাবে। কেন ওঁকে অভিযুক্ত বলছি, তার প্রমাণ রয়েছে আমাদের কাছে এবং সেগুলি হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো নয়।’’
সোমবার নবান্ন সভাঘরে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকের সময় এক দিকে বসে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর উল্টো দিকে বসেছিলেন আন্দোলনকারী ১৭ জন জুনিয়র ডাক্তার। জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁদের সঙ্গে কিছু ফাইল নিয়ে গিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার যে অভিযোগ তাঁরা করছেন, সেই সংক্রান্ত কিছু প্রমাণ রয়েছে তাঁদের কাছে। সেই প্রসঙ্গ তুলতেই তাঁদের থামিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেছিলেন, ‘‘একটা মানুষকে অভিযুক্ত প্রমাণ করার আগে অভিযুক্ত বলা যায় না। তোমরা অভিযোগ করতে পারো। কিন্তু তিনি অভিযুক্ত কি না, প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’’ ঠিক তখনই জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে এক মহিলাকণ্ঠ বলে ওঠেন, ‘‘যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে অভিযুক্ত বলব। যদি সেই অভিযোগ প্রমাণ হয়, তাঁকে বলব দোষী। ওই ব্যক্তিকে অভিযুক্ত বলা ব্যাকরণ বা আইনের দিকে থেকে ভুল না।’’ তিনি যখন এ কথা বলছেন, বক্তব্যের একেবারে শেষ দিকে সভাঘরের ক্যামেরায় তাঁকে ধরা হয়। ‘লাইভ স্ট্রিমিং’-এ দেখা যায়, হাতে পেন নিয়ে নিজের কথা বলছেন তিনি। এক ঝলক ভেসে ওঠে মনীষার মুখ। যদিও কথা বলার সময় তিনি এক বারও নিজের নাম বলেননি।
মনীষার ওই যুক্তি মানেননি মুখ্যমন্ত্রী। যদিও তার পর আর নতুন করে কোনও যুক্তি তুলে ধরেননি তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি জবাব দিইনি। কারণ, আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করতে যাইনি। এটা গৌণ। আমি চাইনি এই ব্যাখ্যা আলোচনার বিষয় হোক। অভিযুক্ত ১০০ বার বলা যায়। এটা নিয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী। আমি যে ভুল না, সেটা জানতাম।’’
আপাতত মনীষাদের দাবি একটাই, ‘নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচার’। নিজেকে বাকিদের থেকে একেবারেই আলাদা ভাবতে নারাজ মনীষা। তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘‘আমি অন্যদের থেকে আলাদা নই। আমাদের সকলের আওয়াজ এক। সোমবারের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ওই কথা বলেছি। ওই যুক্তিটা সকলের মনেই আসবে। মুখ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্য ব্যাকরণগত দিক থেকেও ঠিক নয়। যুক্তির দিক থেকে ঠিক তো নয়ই।’’
আরজি করের নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন, তাঁর সঙ্গে মনীষা জড়িয়ে রয়েছেন প্রথম দিন থেকে। তিনি জানান, গত এক বছর ধরে ‘ইন্টার্নশিপ’ করার সময় হাতেকলমে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তার পরেই বুঝতে পেরেছেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যাগুলো। তাঁর মনে হয়, এখন চুপ করে থাকলে নিজেকে জবাব দিতে পারবেন না। তবে মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় বা তার আগে কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তিনি। নিয়মিত ভোট দিলেও রাজনীতি থেকে দূরেই থাকতেন। ২০১৯ সালেও রাজ্যে মেডিক্যাল কলেজে আন্দোলন হয়েছিল। মনীষা সেই সময় এমবিবিএসের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘সেই সময় স্কুল পাশ করা একটা বাচ্চার যতটা বোঝার কথা, ততটাই বুঝেছি। তাই কোনও আন্দোলনে জড়াইনি। এ বার ন্যায়বিচারের দাবিতেই সকলের সঙ্গে এগিয়ে এসেছি।’’ মনীষা বলেন, ‘‘সব রাজনৈতিক পরিচয় ফেলে, রং সরিয়ে আমরা যুক্ত হয়েছি ন্যায়বিচারের দাবিতে। কোনও রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও তা এখন অতীত। এখন সকলের একটাই পরিচয়, তাঁরা ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের সদস্য।’’
নবান্নের বৈঠকে মনীষা প্রথমে ইংরেজিতেই নিজের কথা বলতে গিয়েছিলেন। নিজের নাম উল্লেখ করেননি। সেই সময় তাঁকে থামিয়ে বাংলায় বলতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। ইংরেজিতে সড়গড় বলেই কি বাংলা ছেড়ে ওই ভাষায় নিজের কথা বলতে শুরু করেছিলেন? মনীষা জানান, তিনি আসলে মুখ্যসচিবের দেওয়া পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে কিছু তথ্য তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এর আগে মুখ্যসচিবের সঙ্গে স্বাস্থ্য ভবনের বৈঠকে যে হেতু বেশির ভাগ সময় ইংরেজিতেই কথা হয়েছিল, তাই এ বারও সেই ভাষাতেই কথা বলতে শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এমনিতে ইংরেজিতে আমি বেশ সড়গড়।’’ গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলে পড়াশোনা করেছেন মনীষা। ছোট থেকে পড়াশোনায় ভালই। শিক্ষিকাদের স্নেহভাজনও ছিলেন।
সেই মেয়েই মুখ্যমন্ত্রীকে শুধরে দিলেন ব্যাকরণগত ভুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy