ঝাড়গ্রাম: মা হওয়া কি মুখের কথা! কথাটা জীবন দিয়ে বুঝেছেন রাখি মান্ডি। সাঁওতাল পরিবারের এই কন্যা ‘সিঙ্গল মাদার’।
বলিউডে অভিনেত্রীদের মধ্যে ‘সিঙ্গল মাদার’-এর কথা শোনা যায়। কিন্তু তাঁদের মতো রাখি সন্তান দত্তক নেননি। বিয়ে না করে, আইভিএফ পদ্ধতিতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মা হয়েছেন তিনি। বছর তেতাল্লিশের রাখির কথায়, ‘‘জীবনটা আমার। তাই সিদ্ধান্তও আমার। সন্তানের মধ্যেই প্রত্যেক মায়ের মতো নিজের পূর্ণতা খুঁজে নিচ্ছি।’’
ঝাড়গ্রাম শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রাখির বাবা বৈদ্যনাথ মান্ডি ছিলেন খড়্গপুরের রেলকর্মী। খড়্গপুরের স্কুলেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পরে, মেদিনীপুর কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যার স্নাতক হন রাখি। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেন স্নাতকোত্তর। ২০০৬ সালে জামবনির বাণী বিদ্যাপীঠে শিক্ষিকা পদে যোগ দেন। চাকরি পেতেই বিয়ের সম্বন্ধ আসছিল। কিন্তু রাখির মতে, ‘‘বিয়ে হলেই যে সম্পর্ক টিকবে, কে বলতে পারে? সংশয় ছিল। তাই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিই।’’
পরিজনেরা বোঝাতে শুরু করেন, বিয়ে না করলে এক সময় একা বাঁচতে হবে। এর পরেই ‘একা মা’ হওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু করেন রাখি। ২০১৭-য় সংবাদপত্রে কলকাতার এক ‘সিঙ্গল মাদার’-এর কথা নাড়া দেয়। ২০২০ সালে ‘লকডাউন’-এর আগেই রাখি পৌঁছন চেন্নাই। সেখানকার বেসরকারি হাসপাতালে এক মহিলা চিকিৎসককে নিজের ইচ্ছে জানান। চিকিৎসক শারীরিক ঝুঁকির বিষয়গুলি বললেও, রাখি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
বাড়ি ফিরে মা আরতি মান্ডিকে মনের কথা জানান রাখি। তিনি রাজি হন। মেয়ের ইচ্ছায় বাধা হননি রাখির বাবা বৈদ্যনাথ। এর পরে কলকাতায় চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন রাখি। তবে ২০২১ সালে তিনি করোনা আক্রান্ত হন। সুস্থ হওয়ার পরে শুরু হয় আইভিএফ প্রক্রিয়া। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপন হয় রাখির গর্ভে।
ছিল প্রশ্ন, অন্যেরা ব্যাপারটা কী ভাবে নেবেন! স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও রাখির সহকর্মীরা পাশে দাঁড়ান। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় প্রথম পাঁচ মাস ছুটি নেননি রাখি। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের সব বোঝানোর পরে এক ছাত্রই স্কুলের ধকল নিতে বারণ করেছিল। পড়ুয়াদের এতটা সমর্থন পাব, ভাবিনি!’’
তবে জনজাতি কন্যার সাহসী পদক্ষেপ মানতে পারেননি সমাজ ও পরিজনেদের অনেকে। সন্তান জন্মানোর ঠিক আগে মাস চারেক আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একাই ছিলেন রাখি। ২০২২-এর অগস্টে মারা যান রাখির বাবা। সে সময় রাখির গলব্লাডারে স্টোন ও প্যাংক্রিয়াটাইটিস ধরা পড়ে। গর্ভে সন্তান থাকায় অস্ত্রোপচার সম্ভব ছিল না। ২০২২ সালের অক্টোবরে ‘সিজ়ার’ করে মেয়ে হয় রাখির।
সেই মেয়ে ইশানভী ওরফে মোহরের এখন আড়াই বছর বয়স। স্কুলে যাচ্ছে। ঝাড়গ্রামের বাড়িতে মা, দাদা-বৌদি-ভাইঝির সঙ্গেই মেয়েকে নিয়ে থাকেন রাখি। মোহরের জন্মের শংসাপত্রেও শুধু রাখির নাম। আরতি বলেন, ‘‘এখনও আত্মীয়দের অনেকে ব্যাপারটা মানতে পারেনি। তবে মোহরকে কোলে নিয়ে রাখির হাসিমুখই আমাদের পরম পাওয়া।’’ রাখির স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিতাভ পাহাড়ির কথায়, ‘‘ওঁর মানসিকতাকে কুর্নিশ।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)