Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

রোগ নেই, তবু ‘মনোরোগী’ এক বছর

একাধিক বার এমন মার জুটেছে। রাতে ঘুমটুকুও সম্ভব ছিল না বেশির ভাগ সময়ে। অনিয়মিত ছিল খাওয়াদাওয়াও। মানসিক রোগী না-হয়েও মানসিক হাসপাতালে টানা এক বছর কাটাতে বাধ্য হওয়া 

পর্ণা আচার্য চৌধুরী

পর্ণা আচার্য চৌধুরী

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৯ ০৪:০৮
Share: Save:

ওয়ার্ডের এক ধারে বসে শরৎ রচনাবলি পড়ছিলেন। হাত থেকে কেড়ে সেই বই সজোরে তাঁর মাথায় মারলেন এক রোগিণী। আঘাতের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে বৃদ্ধা বুঝতে পারলেন, শুধু মাথায় চোট নয়, চশমার কাচও ভেঙেছে।

একাধিক বার এমন মার জুটেছে। রাতে ঘুমটুকুও সম্ভব ছিল না বেশির ভাগ সময়ে। অনিয়মিত ছিল খাওয়াদাওয়াও। মানসিক রোগী না-হয়েও মানসিক হাসপাতালে টানা এক বছর কাটাতে বাধ্য হওয়া

৭৫ বছরের পর্ণা আচার্য চৌধুরী দুঃস্বপ্নের জীবন কাটিয়ে সোমবার গেলেন নতুন আশ্রয়, সমাজকল্যাণ দফতরের বৃদ্ধাবাসে।

উচ্চ রক্তচাপ আর ক্যালসিয়ামের ঘাটতি কমানোর ট্যাবলেট। শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা বলতে এ টুকুই। অঙ্ক নিয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করা, বেসরকারি সংস্থার প্রাক্তন চাকুরে পর্ণার জীবনটা তবু গত কয়েক বছর হাসপাতালেই কেটেছে। কিন্তু শেষ এক বছরের বিভীষিকা তিনি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। সমাজকল্যাণ দফতরের হস্তক্ষেপে সোমবার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল থেকে সরকারি বৃদ্ধাবাসে তাঁর ঠাঁই হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হল, সেই নিয়ে সরকারি স্তরে নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে মঙ্গলবার থেকেই।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, পায়ের গুরুতর সমস্যা নিয়ে বছর কয়েক আগে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। নিকট আত্মীয় তেমন কেউ না-থাকায় অবিবাহিতা পর্ণা থাকতেন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে। অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তির পরে সেই আত্মীয়েরা আর খোঁজ নেননি। আর জি কর থেকে পর্ণাকে পাঠানো হয় বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে। সেখানেও একই অবস্থা। ফিরিয়ে নেওয়ার কেউ না-থাকায় তিনি বছর কয়েক থেকে গিয়েছিলেন হাসপাতালেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এর পরে তাঁর ঠাঁই হয় লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে। যেখানে তাঁকে দেখে চমকে উঠেছিলেন চিকিৎসকেরা। বড়সড় সমস্যা তো দূরের কথা, ছোটখাটো মানসিক অসুবিধাও তো নেই! তা হলে এই বৃদ্ধা মানসিক হাসপাতালে কেন? চিঠি দেওয়া হয় স্বাস্থ্য দফতরে। চিঠি যায় সমাজকল্যাণ দফতরেও। কিন্তু আর পাঁচটা সরকারি সিদ্ধান্তের মতো এ ক্ষেত্রেও লেগে গেল দীর্ঘ সময়।

লুম্বিনী পার্কের চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘এত ঝড়ঝাপটার পরেও উনি যে মানসিক ভাবে সুস্থ রয়েছেন, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। ওঁর এখানে থাকতে বাধ্য হওয়া আমাদের সকলের লজ্জা।’’ একই কথা বলেছেন সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকেরাও। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘কেন অকারণে এক জনকে মানসিক হাসপাতালে যেতে হল, সেই কারণ চিহ্নিত করা না-গেলে ভবিষ্যতে আরও অনেকের সঙ্গেই এমন ঘটতে পারে।’’

বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালের সুপার পার্থপ্রতিম গুহ বলেন, ‘‘ব্যাপারটা তো আমাদের মনগড়া নয়। মনোরোগ চিকিৎসকের শংসাপত্রের ভিত্তিতেই আদালত নির্দেশ দিয়েছিল। পর্ণাদেবী ওয়ার্ডে মাঝেমধ্যেই সমস্যা তৈরি করতেন। রেগে যেতেন। ওঁকে নিয়ে সকলেরই আপত্তি ছিল।’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, কোন শংসাপত্রের ভিত্তিতে এই আবেদন করা হয়েছিল, তা যাচাই করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।

সমাজকল্যাণ দফতরের পাশাপাশি যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় হাসপাতাল থেকে বেরোতে পারলেন পর্ণা, সেই সংগঠনের প্রতিনিধি শুক্লা দাস বড়ুয়া জানান, নিয়ম অনুযায়ী মানসিক হাসপাতালে কোনও রোগীকে যিনি ভর্তি করেন, ছুটির সময়ে তিনিই সই করে নিয়ে যান। কোনও কারণে তিনি না-এলে অন্য কেউ আসেন। কিন্তু নিজের দায়িত্বে রোগী হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, সচরাচর এমন ঘটে না। অতি সম্প্রতি এই নিয়মে খানিকটা ছাড় মিলছে ঠিকই। কিন্তু রোগীকে একা ছাড়লে যদি তাঁর কোনও বিপদ হয়, তা হলে তার দায় হাসপাতালের উপরে এসে পড়বে এই আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ বেশির ভাগ সময়েই বেঁকে বসেন। শুক্লার কথায়, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই সুস্থ হওয়ার পরে অনেককে বাড়ির লোকেরা ফিরিয়ে নিতে চান না। বছরের পর বছর থেকে যেতে হয় মানসিক হাসপাতালেই। এ থেকে বেরোনোর জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। তবে পর্ণাদির ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা ভয়াবহ। এক জন সুস্থ মানুষকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ভুলে এ ভাবে মানসিক হাসপাতালে কাটাতে হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।’’

নতুন পরিবেশে কেমন লাগছে? এই প্রশ্নের উত্তরে এ দিন সকালে পর্ণা বলেন, ‘‘শেষের দিকে, ওয়ার্ডের রোগীদের মধ্যে ঝামেলা হলে আমিই মেটাতাম। ডাক্তার-নার্সরা ভরসা করতে শুরু করেছিলেন। এখন শুধু ভাবছি, যাঁরা সুস্থ হয়েও ভিতরে থেকে যেতে বাধ্য হন, তাঁদের অবস্থা কতটা মর্মান্তিক।’’

কী ভাবে দিন কাটত? বললেন, ‘‘আমি বরাবর পড়তে ভালবাসি। রবীন্দ্র রচনাবলি, শরৎ রচনাবলি জোগাড় করে ফের পড়া শুরু করেছিলাম। মনে মনে অঙ্কের জটিল সব সমস্যার সমাধান করতাম। এক সময়ে অঙ্কই তো ধ্যানজ্ঞান ছিল!’’

এই পর্যন্ত বলে থমকান বৃদ্ধা। ম্লান হেসে বলেন, ‘‘দেখুন তো! অঙ্কের সমাধান করে গেলাম সারা জীবন। কিন্তু জীবনের

সমস্যাগুলো কেমন জট পাকিয়েই থেকে গেল।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Old Woman Health Department Mental Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy