টটকো জলাধারের একাংশে জমে থাকা অল্প জলেই স্নান। —নিজস্ব চিত্র।
‘‘আর কত দিন যে টটকোর কাদা জলে স্নান করতে হবে’’— হাতে-পায়ে সর্ষের তেল ঘষতে ঘষতে বিড় বিড় করছিলেন ষাটোর্ধ্ব রাসবিহারী মাহাতো। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের বড়পড়্যাশা ও গুড়ুর গ্রামের মাঝামাঝি টটকো জলাধারে তখন হাঁটু জলে কোনও রকমে ডুব দিচ্ছেন মাঝবয়সি বিশ্বজিৎ মাহাতো। রাসবিহারীর কথা কানে যেতে বলে উঠলেন, ‘‘যা বলেছ! ভরা বর্ষা, কিন্তু বৃষ্টির তেজ নেই। ঝিরিঝিরি এই বৃষ্টির ভরসায় আমন চাষ করব কী করে? টটকো না ভরলে শীতের আনাজ চাষে সেচের জলই বা মিলবে কোথায়?’’
টটকো ওই এলাকারই একটি ছোট নদী। তার উপরে জলাধারটিও একই নামে পরিচিত। মজে যাওয়া সেই টটকো জলাধারের উপরই ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা এই জনপদের বাসিন্দাদের জীবনের অনেকটা নির্ভর করে। ভারী বৃষ্টি হলে আশপাশের নদী-নালার জল নেমে আসে টটকো জলাধারে। কিন্তু গভীরতা কমে যাওয়ায় লকগেট খুলে জল বার করে দিতে হয়।
এত দিনেও টটকোর সংস্কার হল না? জলাধারের পাশের মোরাম রাস্তায় অচেনা মুখ থেকে প্রশ্নটা শুনে থমকে দাঁড়ান এক প্রৌঢ়। চারপাশটা দেখে নিয়ে গলা এক পর্দা নামিয়ে বলেন, ‘‘সরকার মেলা-উৎসব করে কত টাকাই না ওড়াচ্ছে! কত ভাতা দিচ্ছে। কিন্তু এই বাজারে পাঁচশো, হাজারে কী হয়? বরং ওই সব টাকায় সরকার আমাদের এই জলাধারটা পরিষ্কার করে দিলে বছরভর জল জমে থাকত।’’
নতুন প্রজন্মের মুখে আবার কর্মসংস্থানের দাবি। ঝাড়খণ্ডে রংমিস্ত্রির কাজ থেকে সদ্য গুড়ুর গ্রামের বাড়িতে ফেরা সুফল কর্মকার বলেন, ‘‘এখানে চাষের কাজ ছাড়া আর কী রয়েছে? তা-ও সারা মাস জোটে না। চার বছর ধরে জামশেদপুরে রঙের কাজ করছি। দৈনিক ৪৫০-৫০০ টাকা পাচ্ছি।” ঘরভাড়া করে তিনি স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘জেলাতেই যদি বড় কারখানা খুলত, তা হলে কি আর ঘর ছেড়ে থাকতাম?’’
ভাতার টাকায় অবশ্য বৃদ্ধ রাসবিহারী মাহাতোর মতো অনেকেরই সুরাহা হয়েছে। তিনি জানালেন, সদ্য চালু হওয়া বার্ধক্যভাতা, স্ত্রীর লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকায় কিছুটা উপকার হচ্ছে বইকি। তবে গুড়ুর গ্রামের বধূ রূপালি মাহাতো চান লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা বাড়ানো হোক। তাঁর কথায়, ‘‘একশো দিনের কাজ বন্ধ। লোকের জমিতে কাজও রোজ জোটে না। যা বাজারদর, তাতে লক্ষ্মীর ভান্ডারের ৫০০ টাকায় কী হয় বলুন?’’
বেলা যত গড়ায় জলাধারের পাড়ের রাস্তা ধরে এ গ্রামে-সে গ্রামে লোকজনের যাতায়াত চলতেই থাকে। মোটরবাইকে দু’টি জেরিক্যান ঝুলিয়ে বড়পড়্যাশা গ্রামে সৌরপাম্প থেকে জল আনতে যাচ্ছিলেন গুড়ুর গ্রামের নিমাই দত্ত। বাইক থামিয়ে বললেন, ‘‘পাইপলাইন বসানোর জন্য কবেই খোঁজখবর নিয়ে গিয়েছেন সরকারি বাবুরা। কাজ কিছুই হয়নি। একটা ছাড়া সব নলকূপই শুকিয়ে গিয়েছে। তাই পাশের গ্রামে জল আনতে যাচ্ছি।’’ এলাকায় এমন ‘নেই’ কম নেই। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, গুড়ুর জুনিয়র স্কুল শিক্ষকের অভাবে বছর তিনেক ধরে বন্ধ। স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অন্তর্বিভাগও বন্ধ।
এরই মধ্যে জনজাতি স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করে আসা কুড়মি সমাজ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার ডাক দিয়েছে। তৃণমূলকে ভোট না দিতে প্রচার করছে। গুড়ুর পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ৭০ শতাংশ কুড়মি জনবসতি। কুড়মি সমাজের সমর্থন নিয়েই সাত জন নির্দল হয়ে ভোটে লড়ছেন। তার মধ্যে পাঁচটি আসনেই তৃণমূলের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি লড়াই। কুড়মি সমাজ সমর্থিত নির্দলেরা রয়েছেন পঞ্চায়েত সমিতির তিনটি ও জেলা পরিষদের একটি আসনেও।
আদিবাসী কুড়মি সমাজের বান্দোয়ানের যুব সভাপতি প্রশান্ত মাহাতো বলছেন, ‘‘এ বার কুড়মিরা উচিত শিক্ষা দেবেন।’’ বিজেপির বান্দোয়ান বিধানসভার আহ্বায়ক কমলাকান্ত মান্ডি বলেন, ‘‘ভাতার নামে রাজ্যের ভাঁওতাবাজি ধরা পড়ে গিয়েছে। মূল সমস্যা সমাধানেই সরকারের নজর নেই।’’ বান্দোয়ানের তৃণমূল বিধায়ক রাজীবলোচন সরেনের অবশ্য দাবি, ‘‘এলাকার সবাই সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন। সব রাস্তা পাকা হয়েছে। পানীয় জল মিলছে। জলাধার সংস্কারের প্রস্তাব পাঠানো আছে। তবে বহু পুকুর সংস্কার হয়েছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যেও নজর রয়েছে।’’
বাকিটা? টটকোর পাশে দাঁড়ানো প্রৌঢ় উদাস চোখে অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘দেখা যাক!’’ তার পরে হন হন করে রওনা দিলেন গন্তব্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy