Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Train accident

মৃতদেহের উপর দিয়েই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ছেলেকে নিয়ে ছুটেছি

পাঁচ বছর ধরে বেঙ্গালুরুতে নির্মাণকর্মী হিসাবে কাজ করছি। স্ত্রী দোলাহার সেখানে কয়েকটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। এক বছর আগে শেষ বার মুড়াগাছায় গ্রামের বাড়িতে এসেছিলাম।

এক ছেলেকে নিয়ে আশু শেখ। শনিবার, হাওড়া স্টেশনে পৌঁছনোর পরে। নিজস্ব চিত্র

এক ছেলেকে নিয়ে আশু শেখ। শনিবার, হাওড়া স্টেশনে পৌঁছনোর পরে। নিজস্ব চিত্র

আশু শেখ, (দুর্ঘটনাগ্রস্ত যশবন্তপুর-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের যাত্রী)
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩ ০৯:২১
Share: Save:

হঠাৎ যেন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছি। কোনও মতে তাকিয়ে দেখি, কিছুটা দূরে পড়ে আছেন আমার স্ত্রী। আমাদের দশ বছরের ছেলে সাকিল ওর ভাই, পাঁচ বছরের সালামকে কোলে নিয়ে বসে অঝোরে কেঁদে চলেছে। সালাম নড়াচড়া করছে না! উঠে যে ওদের কাছে যাব, সেই শক্তিও যেন শরীরে নেই। সামান্য নড়তেই দেখি, পাঁজরে প্রবল ব্যথা। তা নিয়েই যে কোনও মতে মুড়াগাছায় নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পেরেছি, ভাবতে পারছি না। সব চেয়ে বড় কথা, এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার পরেও আমার গোটা পরিবার বেঁচে রয়েছে। সেটাই বিশ্বাস হচ্ছে না!

পাঁচ বছর ধরে বেঙ্গালুরুতে নির্মাণকর্মী হিসাবে কাজ করছি। স্ত্রী দোলাহার সেখানে কয়েকটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। এক বছর আগে শেষ বার মুড়াগাছায় গ্রামের বাড়িতে এসেছিলাম। ইদেও আসা হয়নি বলে বাড়ির লোকজন ধরেছিল। তাই ঠিক করি, গ্রামে আসব। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টায় যশবন্তপুর-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ধরি। ট্রেন দু’ঘণ্টা দেরিতে চলছিল। দুপুরের খাওয়া সেরে মোবাইলে তাস খেলছিলাম। ছেলেরা খেলছিল ওদের মায়ের ফোন নিয়ে। সন্ধ্যা ৭টার আশপাশে হঠাৎ প্রবল জোরে ঝাঁকুনি! এর পরে আর কিছুই মনে নেই।

জ্ঞান ফিরতে দেখি, আমি ট্রেনের সিটের ফাঁকে। আমার স্ত্রীরও একই অবস্থা। দুই ছেলে শুধু একটি সিটের গায়ে বসে ছিল কোনও মতে। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বুঝতে পারি, আমাদের কামরা উল্টে গিয়েছে। লোকজন সব চিৎকার করছেন। কেউ কেউ কাঁদছেন পরিজনদের আঁকড়ে ধরে। পাশে বসা যে বৃদ্ধা গোটা রাস্তা আমার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে করতে এলেন, দেখি, তাঁর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। তাঁর ছেলেরও মাথা ফুঁড়ে রক্ত পড়ছে। ওঁকে কয়েক বার ডেকেও সাড়া না মেলায় স্ত্রী ও ছেলেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি। সালাম সাড়া দিচ্ছে না দেখে চোখে-মুখে জল ছেটাই। তাতেও কাজ না হওয়ায় কামরা থেকে দ্রুত বেরোনোর চেষ্টা করি। কিন্তু দরজা কোন দিকে, বুঝতে না পারায় জানলা ভেঙে বেরোতে হয়। আমাদেরই সঙ্গে থাকা একটি ছেলেকে নিয়ে তার পরিবার গিয়েছিল চিকিৎসা করাতে। সেই ছেলেটির বাবাই জানলা ভাঙেন।

বাইরে বেরিয়ে হতভম্ব হয়ে যাই! যা দেখছি, তা যেন অবিশ্বাস্য! একের পর এক রেলের কামরা খেলনা গাড়ির মতো এ দিক-ও দিক পড়ে রয়েছে। তার মাঝেই মানুষের মৃতদেহ। ওই মৃতদেহের উপর দিয়েই কোনও মতে এক ছেলেকে কাঁধে ফেলে, স্ত্রী এবং আর এক ছেলের হাত ধরে ছুটতে শুরু করি। পুলিশের পোশাক পরা এক জনকে দেখে জানাই, ছেলের জ্ঞান নেই। তিনিই আমাদের একটি টোটোয় তুলে দেন। কাছের স্টেশনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। ওই স্টেশনের নামটা আর মনে করতে পারছি না। সেখানে ছেলের জ্ঞান ফেরান চিকিৎসকেরা। আমার পাঁজরের হাড় ভেঙে থাকতে পারে বলে জানানো হয়। বলা হয়, আমাদের হাওড়ার ট্রেনে তুলে দেওয়া হচ্ছে। হাওড়ায় গিয়ে যেন এক্স-রে করিয়ে নিই। ভোর ৪টে নাগাদ আমাদের হাওড়ার ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। রাতটা কী ভাবে কেটেছে, বলে বোঝাতে পারব না। দুটো মোবাইল ফোনই হারিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে থাকা পাঁচ হাজার টাকাও নেই। কোনও ব্যাগও খুঁজে পাইনি আর। শুধু ওড়িশার স্টেশনে দেওয়া জলের বোতল হাতে হাওড়ায় এসে নেমেছি।

ছেলেটার এখনও মাথা ঘুরছে। কাহিল লাগছে আমারও। হাওড়ায় নেমে কোনও মতে বাসে উঠে রাতে গ্রামে ফিরেছি। কবে কাজে যেতে পারব, জানি না। ট্রেনে ওঠার সাহস আর দেখাতে পারব কি না, তা-ও জানি না। শুধু আমার ছেলে দুটোর মুখ চোখের সামনে ভাসছে। আর ভাসছে, চাপ চাপ রক্ত, এখানে-ওখানে পড়ে থাকা মৃতদেহ।

অন্য বিষয়গুলি:

Train accident Howrah Station
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy