E-Paper

অভিযোগ কম, বয়স্করা অত্যাচারিত নীরবে

মহিলা, শিশু, বয়স্ক মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে রাজ্যে। কেন এই বিপন্নতার মেঘ?

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ০৫:৫৩
Share
Save

শৌচাগার থেকে মিলেছিল প্রবীণ দম্পতির দেহ। পুজোর মধ্যে, গত ১২ অক্টোবর রাতে পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরের সগড়ভাঙায়। অভিযোগ, সম্পত্তি ও টাকার লোভেছেলে-বৌমা দম্পতির উপরে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাত। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ছেলে-বৌমাকে ধরেছে পুলিশ।

জমি লিখিয়ে দেওয়ার জন্য মাকে মারধর করে ছেলে। মুর্শিদাবাদের রানিতলার সে ঘটনায় গত ১৮ অক্টোবর মা মাসুদা বিবি ছেলে আনারুল শেখের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। পুলিশ মারধর, খুনের চেষ্টাএবং বয়স্কদের রক্ষণাবেক্ষণ আইনের ধারায় মামলা করে। আনারুল বর্তমানে জেল হেফাজতে।

পারিবারিক পরিসরের বাইরেও প্রবীণদের উপরে হামলার একাধিক ঘটনা রয়েছে হুগলিতে। শাসক দলের দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় কয়েক বছর আগে লাঠি-রড দিয়ে খানাকুলের ময়াল গ্রামের বছর পঁয়ষট্টির নিমাইচন্দ্র বরকে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ ওঠে। সে মামলা চলছে। শাসক দলের মদতে জায়গা দখল করে রাস্তা নির্মাণে বাধা দিতে গেলে গোঘাটে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ে দিলীপ প্রতিহার নামে এক বৃদ্ধ মারা যান। অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা চলছে সে ঘটনাতেও।

‘‘অভিযোগ পেতে হবে,’’ বয়স্কদের উপরে হওয়া অত্যাচার নিয়ে পুলিশ কতটা সক্রিয় জানতে চাওয়ায়, বলে ওঠেন রাজ্য পুলিশের এক কর্তা। পুলিশের দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা অভিযোগ করতে চান না। আলিপুরদুয়ারের এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘বাবা-মায়েরা চান, পুলিশ সন্তানকে বকেঝকে ভুল ধরিয়ে দেবে। জেলার বিভিন্ন থানা এলাকা থেকে মাসে অন্তত ১০-১২টি এমন অভিযোগ আমাদের কানে আসে। তবে সব ক্ষেত্রে মামলা হয় না।’’ সম্প্রতি তেমন অত্যাচারের অভিযোগ উত্তর দিনাজপুরে তিনটি, হুগলির আরামবাগ মহকুমায় মাসে গড়ে এক থেকে দু’টি, পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি, তমলুক এবং হলদিয়ায় কয়েকটি, নদিয়ার মহকুমাশাসকের (রানাঘাট) কাছে অন্তত দশটি গত এক বছরে জমা পড়েছে। কিন্তু পুলিশ সূত্রেরদাবি, ঘটনার তুলনায় অভিযোগ অনেক কম।

এই দাবি মিলছে কলকাতার লালবাজারের পুলিশকর্তাদের সঙ্গে। কলকাতা পুলিশ বয়স্কদের জন্য ‘প্রণাম’ প্রকল্প চালু করেছে। প্রায় ১৬ হাজার প্রবীণ এই প্রকল্পে যুক্ত হলেও বহু ক্ষেত্রেই পরিবারের চাপে পুলিশ পদক্ষেপ করতে পারে না বা প্রবীণেরা অভিযোগ তুলে নিতে চান বলে দাবি লালবাজারের কর্তাদের।

তা বলে সব দায়ই কি ‘অত্যাচারিত’ বয়স্কদের? প্রতি মাসে কলকাতার সমস্ত থানা মিলিয়ে প্রবীণদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের হয় প্রায় দু’শোটির উপরে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সব জায়গায় পৌঁছে পরিষেবা দেওয়া যায় না বলে খবর পুলিশ সূত্রের। এ জন্য পুলিশের তরফে থানায় এক জন করে ‘নোডাল অফিসার’ থাকলেও, সময়ে সময়ে সে অফিসার বদল হওয়ায় বহু ক্ষেত্রে কাজ হয় না। বহু ক্ষেত্রে আবার অভিযোগ পেয়েও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি— এই অভিযোগে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে প্রবীণদের। উদাহরণও রয়েছে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের চুয়াপুর লাগোয়া এলাকায়।

এই পরিস্থিতিতেই সম্প্রতি ‘ওয়ার্ল্ড এল্ডার অ্যাবিউজ় অ্যাওয়ারনেস ডে’ বা বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসে উপলক্ষে সমীক্ষা করে কলকাতা পুলিশের কমিউনিটি পুলিশিং বিভাগ। লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক অফিসার জানান, সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রতি সাত জন প্রবীণের মধ্যে অন্তত তিন জনই নির্যাতনের শিকার মহানগরে। নির্যাতনের শিকার যাঁরা হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে ৩২ শতাংশ আত্মীয়দের কাছে, ২১ শতাংশ বন্ধু বা দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্তের দ্বারা এবং ২০ শতাংশ প্রতিবেশীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বাকিরা সরাসরি সন্তান এবং সন্তানদের সঙ্গীদের হাতে নির্যাতিত হন বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এঁদের মধ্যে যে সমস্ত প্রবীণ একা থাকেন (প্রায় ৮.২ শতাংশ) এবং যাঁরা সন্তানদের সঙ্গে থাকলেও জীবনসঙ্গীকে হারিয়েছেন (প্রায় ৫.৪ শতাংশ), তাঁরা নির্যাতনের শিকার হন তুলনায় বেশি। ওই পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এক জন প্রবীণ কী-কী ভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন বা কাকে নির্যাতন হিসাবে ধরে নিয়ে পদক্ষেপ করা যায়, সে ধারণাই স্পষ্ট নয়।’’

পুলিশ জানাচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই (ডব্লিউএইচও) ঘোষণা করেছে, প্রবীণেরা নির্যাতিত হতে পারেন শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে। যুক্ত হতে পারে যৌন নির্যাতনও। শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের ব্যাপারে তেমন ধোঁয়াশা না থাকলেও, দোষ দেওয়া, হুমকি দেওয়া, বকাঝকা করা, অপমান করা, দিনের পর দিন অবহেলা করার মতো বিষয়কে আবেগে আঘাতের দিক থেকে দেখে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে বলে ধরা যায়। কিন্তু সে ব্যাপারে ‘নির্যাতিত-নির্যাতিতা’র ধারণা থাকে না। সম্পত্তি চুরি, এটিএম ও ক্রেডিট কার্ড, ব্যাঙ্ক, ডাকঘরের পাসবইয়ের অপব্যবহার, জোর করে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র হাতবদল অর্থনৈতিক নির্যাতন হিসাবে ধরা যায়। আর একটি নির্যাতন হল, বয়স্কদের অসুস্থতাকে গুরুত্ব না দেওয়া। চাইলে, সে ক্ষেত্রেও আইনের পথে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাববে কে? কে বা কারা তাঁকে নদিয়ার নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালের করিডরে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল, তা-ই মনে করতে পারেন না মানসিক ভাবে অসুস্থ প্রবীণা গায়ত্রী ভট্টাচার্য। করিডরই এখন তাঁর বাসস্থান। নবদ্বীপ শহরে এমন মহিলার সংখ্যা এখন অগুন্তি। স্বামীহারা মহিলা, সন্তানহীন মা কিংবা সহায়-সম্বলহীন বয়স্কদের গঙ্গার ঘাট, স্টেশন বা মন্দির চত্বরে ছেড়ে চলে গিয়েছে বাড়ির লোক। এঁদের একটা বড় অংশ ফাইফরমায়েশ খাটার জন্য ঠাঁই পান নবদ্বীপ বা মায়াপুরের অসংখ্য মঠ-মন্দিরের কোনওটিতে। শরীর অচল হলে সম্বল ভিক্ষাবৃত্তি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেখেছে, বয়স্কদের সুস্থ রাখাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। সে জন্যই ২০২০ থেকে ২০৩০, এই দশককে ‘ডেকেড অব হেলদি এজিং’ বলে ঘোষণা করেছে তারা। যদিও সম্পত্তি, টাকার জন্য আপনজন যখন শত্রু হয়ে ওঠে, প্রবীণদের পক্ষে সুস্থ (‌হেলদি) থাকা আদৌ সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন থাকেই।

(আগামিকাল দাদা-তন্ত্র)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Senior Citizens West Bengal Mental Depression torture

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।